নিজস্ব প্রতিনিধি: মিড ডে মিল ব্যবস্থাকে কার্যত প্রহসণে পরিণত করেছে কেন্দ্রের বিজেপি এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার। দীর্ঘদিন ধরে কেবল নামমাত্র ‘সাম্মানিক’এ ছাত্র-ছাত্রীদের খাবার জোগাতে পরিশ্রম করে চলেছেন এই রাজ্যের মিড ডে মিলের রন্ধনকর্মীরা। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের জন্য যে সাম্মানিক ধার্য করেছিলো, ১৫ বছরে তার কোনও বৃদ্ধি করেনি। রাজ্য সরকারের প্রদেয় অংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে কেরালা সহ অনেক রাজ্যে মিড ডে মিল কর্মীদের সাম্মানিক বৃদ্ধি করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার সামান্যই বাড়িয়েছে। ফলে মাত্র ২ হাজার টাকায় রান্নার কাজ করতে হচ্ছে এরাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীদের। কেরালা ও তামিলনাডু নিজস্ব উদ্যোগে এই সাম্মানিক ১২ হাজার টাকার কাছাকাছি নিয়ে গেছে, কিন্তু এই রাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীদের মজুরি বহুবার বিক্ষোভের পরেও ২ হাজার টাকা পার করাতে পারেনি সরকার। সাম্মানিক বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা, স্থায়ী চাকরি সহ নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করছেন মিড ডে মিল কর্মীরা।  কিন্তু উভয় সরকারের বঞ্চনা ছাড়া কিছু মেলেনি বলে অভিযোগ মিড ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চের।  
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে হারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, মিড ডে মিল কর্মীদের বেতন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি বিগত এক দশকে। ২০০৯ সালের দ্রব্যমূল্য এবং বর্তমানের বাজারের হাল তুলনামুলক বিচার করলেই বোঝা যায় এই সামান্য টাকায় একজন ব্যক্তির পক্ষে নিজের খরচ চালানোও কঠিন। এক্ষেত্রে নিজের রাজ্যের কথা চিন্তা করে কিছু রাজ্যের সরকার নিজেদের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পটি সাফল্যের সঙ্গে চালাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ শতাংশ এবং রাজ্য সরকার বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ প্রদান করবে মিড ডে মিল প্রকল্পে।  কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই হিসাবের বাইরে রাজ্যগুলি নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে এই প্রকল্প চালাচ্ছে। কেরালা তার মধ্যে সবার আগে রয়েছে। কেরালায় যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার দেয় মাত্র ৬০০ টাকা, রাজ্য সেখানে ১১৪০০ টাকা দিয়ে মোট ১২ হাজার টাকা দেয় প্রত্যেক মিড ডে মিল কর্মীদের। অথচ পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় হাজার টাকা, সম্প্রতি তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ হাজার টাকা।
গত বছর ডিসেম্বরে মিড ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চের ডাকে পাঁচ হাজারের বেশি মিড ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মী কলকাতার রাজপথে তাঁদের ন্যায্য দাবি  নিয়ে বিক্ষোভ করে। কর্মীদের দাবি ছিল, তাদের  ন্যূনতম ২৬০০০ টাকা মজুরি দিতে হবে আর যতদিন না তার ব্যবস্থা হয়, ততদিন রাজ্য সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। কর্মীদের অভিযোগ সারা বছর কাজ করলেও পুজো এবং অন্যান্য ছুটির দোহাই দিয়ে তাঁদের দু’মাসের মজুরি কাটা হচ্ছে অবৈধভাবে, তাই ১০ মাসের বদলে ১২ মাসের মজুরির দাবি জানানো হয়। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রন্ধনকর্মীদের মজুরি দিতে হবে, একইসঙ্গে উৎসবকালীন ভাতা ও সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটিও দিতে হবে।  কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কর্মী হয়েও রন্ধনকর্মীদের  কর্মচারী হিসাবে স্বীকৃতি ও পরিচয় পত্র নেই, অবিলম্বে তা দিতে হবে। সেইসঙ্গে রন্ধনকর্মীদের মিড ডে মিল  খাওয়ার আইনি অধিকার ও ছাত্র-ছাত্রীদের পুষ্টিকর খাবার জোগানের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশের শিক্ষিত ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরি এবং অপুষ্টি থেকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে যে প্রকল্প শুরু করা হয়, তা থেকে সরকার ক্রমশ নিজের দায়িত্ব কমানোর প্রচেষ্টায় দায়িত্বভার নালাবথু বা নান্দি ফাউন্ডেশন কিংবা ভেদান্তা বা ইস্কনের মতো বিভিন্ন এনজিও বা পুঁজিপতিদের হাতে সঁপে দিচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদেরই, কাজেই সরকারি  মিড ডে মিল প্রকল্প বেসরকারিকরণ বা কোনো এনজিও-র হাতে দেওয়া চলবে না। এগুলিই ছিল মিড ডে মিল কর্মীদের দাবি। 
কিন্তু বিক্ষোভ অবরোধের ফলস্বরূপ তারা পেয়েছেন অতিরিক্ত মাত্র ৫০০ টাকা যা ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে রন্ধনকর্মীদের দেওয়া হচ্ছে। তাই সিআইটিইউ অনুমোদিত মিড ডে মিল ওয়ার্কার্সদের সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক এবং ঐক্যমঞ্চের আহ্বায়ক মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই রাজ্যও আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নয়। কেন কেরালা বা তামিলনাড়ুর মতো পশ্চিমবঙ্গ পারে না কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধি করতে?’’ তিনি জানান, মিড ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মী বা সহায়িকাদের সরকার স্থায়ী কর্মচারী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে আইন অনুযায়ী ধার্য ন্যূনতম ন্যায্য মজুরিও দিচ্ছে না। রাজ্যে নিয়ম অনুযায়ী, ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী পিছু  একজন রন্ধনকর্মী নিযুক্ত হয়, সংখ্যা  ৪০ পেরোলে ২ জন ও ১০০ জন পেরোলে ৩ জন কর্মী নিযুক্ত থাকেন। এরপর থেকে প্রতি ১০০ জন পড়ুয়া পিছু ১ জন করে কর্মী বৃদ্ধি হয়। এই পরিসংখ্যানের হিসাবে রাজ্যে প্রায় ২ লক্ষ ৩৩ হাজারের মতো পদ তৈরি হয়ে আছে কিন্তু কাজ করছে আরও অনেক বেশি। তার কারণ এক একটি পোস্টের জন্য একাধিক সেলফ হেল্প গ্রুপ কাজ করছে। ফলে বরাদ্দ ২০০০ টাকাও ভাগ হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।    
এই অবস্থায়, প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট ঐক্য মঞ্চ। এই প্রকল্পে মুলত নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সামগ্রিকভাবে উন্নত করে তোলার লক্ষ্যে সরকারি এবং সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি তাদের উপস্থিতি বাড়ানো এমনকি এই অংশকে স্কুলমুখী করে তোলার জন্য মিড ডে মিল প্রকল্প আনা হয়েছিল। প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া স্থানীয় মহিলাদের, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশকে। কাজেই দীর্ঘদিন ধরে দুই সরকার একদিকে তাদের দিয়ে সমাজের জন্য খাটাচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উন্নয়নে নজর দিচ্ছে না। প্রসঙ্গত, গতমাসেই কেন্দ্রীয় সরকার  মিড ডে মিলের খাবারের জন্য মাথাপিছু নামমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়েছিল। প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত যথাক্রমে ৭৪ পয়সা এবং ১ টাকা ১২ পয়সা বৃদ্ধি করে। প্রয়োজনের তুলনায় এই সামান্য বৃদ্ধিকে বিদ্রুপ বলে মনে করছেন অনেকেই। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে পড়ুয়াদের পুষ্টি জোগাতে এই  বৃদ্ধিকে প্রহসন বলে সমালোচনাও করে শিক্ষক সংগঠনগুলি।
The center has not increased even 1 rupee in 15 years
১৫ বছরে কেন্দ্র বাড়ায়নি ১ টাকাও
 
                                    
                                
                                    ×
                                    ![]() 
                                
                                                         
                                         
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0