বিপন্ন মহিলাদের ভরসা স্থল হয়ে উঠেছে ‘নারী সুরক্ষা কেন্দ্র’। এই সুরক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমেই গরিব, অসহায়দের আইনি সুবিধা দিতে এগিয়ে এসেছে সারাভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। একটি দুটি নয়, অসংখ্য মহিলাদের চোখের জল মুছিয়ে দিতে সমিতির উদ্যোগে এ রাজ্যের জেলায় জেলায় তৈরি হচ্ছে আইনি সুরক্ষা বলয়। খোলা হচ্ছে বিশেষ সেল। ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, পাচার, নিপীড়নের শিকার মহিলাদের আইনের পথ নিতে দিশা দেখাচ্ছেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী সদস্যরা।
সমিতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আইনজীবীদের এক বড় অংশ। রাত বিরেতে পুলিশ অভিযোগ বা এফআইআর না নিতে চাইলে সমিতির নেত্রী সদস্যরা আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে থানাতে পৌঁছে যাচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে পারিবারিক সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে শুধুমাত্র কাউন্সেলিং করে। মেটানো হচ্ছে জমি’র সমস্যা, পারিবারিক বিবাদ, এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যেকার সমস্যাও। 
যেমন ট্যাংরা থানা এলাকার একটি ঘটনায় ড্রাগ অ্যডিক্টেড স্বামী তার স্ত্রী’র ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এই অত্যাচার থেকে নির্যাতিতা মহিলাকে রেহাই দিতে এগিয়ে আসেন নারী সুরক্ষা কেন্দ্রের সদস্যরা। থানায় অভিযোগ জানালে থানা জানায় ছেলেটিকে আটক করা যাচ্ছে না কারণ থানায় নাকি ফোর্স নেই। কোথাও কোনো কাজ না হওয়ায় আইনের পথ নেওয়া হয় এই কেন্দ্রের উদ্যোগে। মামলা ইতোমধ্যেই উঠেছে কোর্টে। নির্যাতিতার ইচ্ছে অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছিন্নতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বারুইপুর থানা অঞ্চলে এক ব্যক্তি এক তরুণীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে না করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। 
অসহায় হয়ে পড়েন ওই তরুণী। এক্ষেত্রেও সুরক্ষা কেন্দ্রের সদস্যরা হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসেন। শুরু হয় আইনগত প্রক্রিয়া। প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা করানো হয়েছে।
শুধু এই ঘটনাই নয়, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী যশোধরা বাগচী এরকমই আরও বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যেমন নদীয়ার রানাঘাটের একটি ঘটনা। পেশায় প্রতিরক্ষা কর্মী এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রী’কে পরিত্যাগ করে অন্য মহিলার সঙ্গে বাস করছেন বলে অভিযোগ। ফলে বঞ্চিত ওই মহিলা অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁকে মামলায় সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে সারাভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। নিয়মিত আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সমিতির সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করছেন গোটা বিষয়টি। একইভাবে তপসিয়া থানা এলাকার একটি ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল অভিযুক্তরা। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির চেষ্টায় এখন আইনি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে নির্যাতিতাকে। 
বারাসত গ্রামীণ অঞ্চলে পারিবারিক সমস্যাও মিটিয়ে দেওয়া গেছে, একটি বিদ্যুতের খুঁটি না বসায় সমস্যা বাড়ছিল পরিবারে, সমিতির চেষ্টায়  সেখানে বিদ্যুৎ খুঁটি বসাতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। মধ্য কলকাতায় একটি পারিবারিক সমস্যা সমিতি’র চেষ্টায় কাউন্সেলিং করেই মিটিয়ে দেওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সমিতির নেত্রীবৃন্দ।  
অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনা লিগাল এইড-এর সহায়তা প্রদান প্রসঙ্গে আত্রেয়ী গুহ জানান, দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি ঘটনার কথা। গরিব পরিবারের একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি মেয়েটিকে ফ্ল্যাট সহ তাঁর সম্পত্তি প্রদান করেন, মেয়েটির বিবাহও দেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই স্বামীর হাতে অত্যাচারের শিকার হতে থাকেন ওই তরুণী। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অভিযোগ তোলেন স্বামীর বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে তাঁদের দুই সন্তানও হয়। অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় ওই তরুণী ৪৯৮ ধারায় মামলাও দায়ের করেন।  যে আবাসনে থাকতেন সেখানকার বাসিন্দাদের সব জানিয়ে চিঠিও দেন ওই তরুণী। এতে ক্ষিপ্ত হন তাঁর স্বামী। এরপর তরুণীকে অপহরণ করে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করে দেওয়া হয়। অভিযোগ, তরুণীর স্বামী শাসক দলের ঘনিষ্ট হওয়ায় স্থানীয় থানা নিস্পৃহ থাকে।
 এরপর আবাসনের বাসিন্দারাই যোগাযোগ করেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তাঁদের সকলের চেষ্টায় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে উদ্ধার পান তরুণী। এই মামলাও এখন চলছে কোর্টে। 
এখন রাজ্যগতভাবে এবং কয়েকটি জেলায় নারী সুরক্ষা কেন্দ্র কাজ করছে। অন্য জেলাগুলিতেও তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। মাঝে কোভিড পরিস্থিতিতে এই কাজ কিছুটা ব্যাহত হলেও এখন কেন্দ্র চলছে পূর্ণ গতিতে। নেত্রীবৃন্দের বক্তব্য, নানা সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা নিয়েও মানুষ আসছেন সমিতির দপ্তরে। পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমধানের চেষ্টা করা হয়। সম্ভব না হলে যিনি অপরাধ করেননি তাঁকে আইনগত সহায়তা ও সহযোগিতা করা হয়। আলোচনার মাধ্যমে মিউচুয়াল ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আইনজীবীদের মাধ্যমে তা কার্যকর করা হয়েছে।  অপরাধের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়, থানাকে সঠিক চার্জশিট এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করা হয়। তবে আইনের দীর্ঘসূত্রতা অনেক সময়েই অপরাধীদের শাস্তির বিলম্ব ঘটায়, তবুও সমিতির চেষ্টা থাকে প্রতিটা মুহূর্তে।
 সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি মনে করে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বাড়ানো প্রয়োজন। ইতোমধ্যে দপ্তরে বেশ কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে। আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সেগুলি খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। 
দরিদ্র মহিলারা আইনি সহায়তা পেতেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে বহু অভিযোগ রয়েছে রাজ্যজুড়ে। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ— নির্যাতিতা মহিলাদের অভিযোগ, প্রথমেই থানায় পুলিশের উলটো চাপের মুখে পড়তে হয় বিপন্ন গরিব পরিবারের অভিযোগকারিণীদের। অভিযুক্তরা যদি শাসকপক্ষের লোক হয়, তাহলে আরও বেশি চাপের শিকার হতে হয় চারদিক থেকে। সাধারণ অপরাধ বা সামাজিক অপরাধের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক আক্রমণ, হত্যাও। সব ক্ষেত্রেই প্রথমেই সেই আক্রমণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেমে আসে মহিলাদের ওপরেই। পারিবারিক অশান্তিতে ভোগেন বহু মহিলা, শিশুরাও বাদ যায় না। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র তথ্য বলছে গার্হস্থ্য হিংসায় এ রাজ্যের স্থান শীর্ষে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে নারী নির্যাতনের ঘটনায় সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই শীর্ষে ছিল বলে উল্লেখ আছে। কয়েকবছর আগে সন্দেশখালিতে ৬১ বছরের প্রৌঢ়াকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও অত্যন্ত নৃশংসতায় গুরুতরভাবে জখম করার পর কিভাবে নিরন্তর লড়াই ও আইনি মোকাবিলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল-সেই উদাহরণও রয়েছে। 
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ বলেন, বহু অসহায় মহিলা আইনের সাহায্য চেয়ে আমাদের কাছে আসেন। তাঁরা যখন তাঁদের অসুবিধা বা সমস্যার কথা বলেন তখন মনে হয় সরকার কতটা দূরে রয়েছেন সাধারণ মানুষের থেকে। প্রতি মুহূর্তে শহর গ্রামে আক্রান্ত হয়ে চলেছেন মহিলারা। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে সমস্ত রাজনৈতিক রঙের উর্ধ্বে থেকে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। নারী সুরক্ষা কেন্দ্রে তাঁরা এসে দেখেন আমাদের অর্থাৎ সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কর্মীদের। এভাবেই সমিতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগসূত্র বাড়ানো যায়। সমিতির তো অত টাকা পয়সা নেই বিপুল খরচ সামলানোর, তবুও আমরা সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকেই চেষ্টা করি। 
আইনজীবী বন্ধুরা আমাদের সাহায্য করেন। যদি পারা যায় কোর্টের বাইরেই ফয়সালা বা মীমাংসার চেষ্টা করা হয় বেশিরভাগ সময়ে কারণ সাধারণত একটা আইনগত প্রক্রিয়া অনেক লম্বা হয়, খরচসাপেক্ষও বটে। পুলিশকে বলেও মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। আগামী দিনে প্রতিটি জেলায় নারী সুরক্ষা কেন্দ্র তৈরি হবে।
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0