voter list

দমদম থেকে সোনারপুর, বারুইপুর, ‘বিন্দু’তে থাকেন ভোটাররা, ‘নেই’, শূন্য, তিন শূন্যেও!

রাজ্য

ছেলের নাম গঙ্গা সামন্ত। বাবার নাম? চিত্তরঞ্জন ভক্ত! বছর বাহান্নর গঙ্গা সামন্তর নাম রয়েছে দমদম উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকায়। বিধানসভা কেন্দ্রের ১নং অংশে তার নাম। উত্তর কলেজ পাড়ার বাসিন্দা বলে ভোটার তালিকায় চিহ্নিত এই ব্যক্তির বাড়ির ঠিকানাও দেওয়া আছে। 
কী তার বাড়ির ঠিকানা? জ্বলজ্বল করছে বাংলায় লেখা সেই বাড়ির নং—  ‘নেই।’ 
তাহলে স্বাধীন দেশের একটি ‘মা মাটি মানুষ’-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজ্য সরকারের শাসনে এই মানুষটি থাকেন কোথায়? স্থানীয়রা কেউ বলতে পারছেন না। বলতে যারা পারবেন তারা চুপ। তৃণমূলের কোনও নেতা এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আর রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলের সময়, সাংগঠনিক সামর্থ্য কোনটিই নেই ভোটার তালিকায় জালিয়াতি খুঁজে বের করার। চেষ্টাও নেই। 
‘নেই’ ঠিকানার ওই বাসিন্দা একটি উদাহরণ।
ওই বিধানসভা কেন্দ্রের ১নং অংশের ১৩৯৪নং সিরিয়ালে একজন মহিলা ভোটদাতা আছেন। তার নামের পাশে ১২টি বাক্স আঁকা আছে। স্বামীর নামের পাশেও অনেকগুলি বাক্স। ঠিকানা আছে। সেটি হলো—  ‘এয়ারপোর্ট সিটি’। এই নামে কোনও শহরাঞ্চল কিংবা গ্রাম নেই। থাকলেও একটি পুরো এলাকা ওই ১২টি বাক্সের নামযুক্ত মহিলার বাড়ি? 
আরও আছে। দমদম উত্তর বিধানসভার একটি এলাকা নিউ বারাকপুরের দক্ষিণ কলেজপাড়া। সেখানে এক মহিলা ভোটদাতার নাম রয়েছে। তার বয়স উল্লেখ করা আছে ৩৮। বাবার নাম দেওয়া আছে—  গুরুদাস পণ্ডিত। মহিলার পদবি ‘ভট্টাচার্য।’ এমনটা হতেই পারে। হয়তো মহিলা বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন করেননি। কিন্তু গোল বেঁধেছে বাড়ির নম্বরে। তার বাড়ির নম্বর হলো—  ‘জিরো জিরো জিরো’। 
এই নম্বরের কোনও বাড়ি নেই। সেখানে নেই। কোথাও থাকার কথা নয়।
কিন্তু তা সত্য নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর দক্ষিণ বিধানসভা। এলাকার নাম উত্তর পশ্চিম রাধাবল্লভপুর। সেখানকার ভোটার তালিকার ৬৫ নম্বরে নাম আছে এক তরুণীর। বাবার নাম দেওয়া আছে। ঠিকানার জায়গায় লেখা আছে—  ‘জিরো।’ অর্থাৎ শূন্য। তবে এই একজনই নয়। সোনারপুর দক্ষিণের উত্তর পশ্চিম রাধাবল্লভপুরে দেখা যাচ্ছে ‘শূন্য’-এ থাকেন অনেকে। যেমন বিজয় মণ্ডল, রাহুল মণ্ডল, মৌসুমী মণ্ডল। আবার শঙ্কর মণ্ডল, লক্ষ্মী মণ্ডল নামে দুই ভোটদাতা ‘এন০০০’-তে থাকেন বলে ভোটার তালিকা জানাচ্ছে। সেই তালিকার ৭৭,৭৮,৭৯,৮১,৮৫,৮৬,৮৭, ৮৮,৯১,৯৩ সহ অনেকগুলি সিরিয়ালে যাদের নাম, তাদের কারও ঠিকানার উল্লেখই নেই।
‘শূন্যের’ বাসিন্দা বারুইপুরেও পাওয়া যাচ্ছে। অনেক। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক। বারুইপুর পশ্চিম বিধানসভার অন্তর্গত বারুইপুর মোহনপুর পূর্ব পাড়ায় মহম্মদ ইমরান (সিরিয়াল নম্বর ১৩), মহম্মদ রহমত (সিরিয়াল নম্বর ১৭)। একই এলাকার পারমিতা কুজুর, বিশাল কুজুর, কৃষ্ণা কর, রিঙ্কু খনরাদের বাড়ির ঠিকানা ‘শূন্য শূন্য’।
‘শূন্য’ ঠিকানা হলে ‘বিন্দু’তেও কী মানুষ থাকতে পারেন? ইংরেজিতে যাকে ফুলস্টপ বলে। তেমন ঠিকানারও হদিশ মিলছে ভোটার তালিকায়। যাদবপুর বিধানসভার ১৪১নং অংশের ১৮নম্বরে এক তরুণীর নাম রয়েছে। তার বয়স উল্লেখ করা আছে। স্বামী হিসাবে একজনের নাম দেওয়া আছে। ঠিকানার জায়গায় দেওয়া আছে একটি বিন্দু, অর্থাৎ ফুলস্টপ! তৃণমূলের জমানায় এমনও সম্ভব। সেই নাম তৃণমূল ভোটার তালিকায় তুলেও রেখেছে। নির্বাচন কমিশন বহাল তবিয়তে তা ছাপিয়েও দিয়েছে। 
শুধু কী তাই? বাড়ির নম্বর ‘H/’e’।  এমনও রয়েছে যাদবপুরের ভোটার তালিকায়। একজনের নয়। ওই বিধানসভার ১৪২নং অংশে অন্তত পাঁচজনের বাড়ির ঠিকানা এমন এবং তারা কেউ আত্মীয় নন। ১৪০ নং অংশে পাঁচ জনের বাড়ির ঠিকানা ‘C/’e’। 
কোথাও আবার তৃণমূল কারসাজি করেছে অন্যভাবে। বাড়ির নম্বর ঠিক আছে। কিন্তু ওই ঠিকানায় যার নাম আছে, সেই মানুষটি নেই। দমদম উত্তর বিধানসভা এলাকার দক্ষিণ কলেজপাড়ার একটি বাড়ির নম্বর ৩০০। সেই ঠিকানায় ৫জন ভোটদাতার নাম আছে। তিনজনের পদবি চক্রবর্তী, একজনের সাহা। আর একজনের ‘গুহা’। সবার নামই বাংলায় লেখা। বাড়িতে পৌঁছে সিপিআই(এম) কর্মীরা জানতে পেরেছেন, ‘গুহা’ পদবি বিশিষ্ট মানুষটির কথা ওই বাড়ির কেউ কখনও শোনেননি, জানেন না। তৃণমূল কায়দা করে চারজন আসল ভোটদাতার বাড়িতে একজন তাদের ‘গুহাবাসী ভোটার’-এর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই নাম ভোটার তালিকায় এখনও আছে।
দমদম উত্তরের ২৬নং বুথে আবার আর এক কাণ্ড। সেখানকার ভোটার তালিকায় ৩৮৪ নম্বরে এক মহিলার নাম আছে। তার স্বামীর নাম দেওয়া আছে। বয়স দেওয়া আছে ২৩। কিন্তু ঠিকানা হিসাবে লেখা আছে ‘ফতুল্লাপুর।’ ফতুল্লাপুর নামে দুটি এলাকা আছে রাজ্যে। একটি ওই বুথ এলাকা থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে। আর একটি মুর্শিদাবাদের সুতি এলাকায়। ওই দুটি জায়গার কোনও একটিতে নিশ্চয়ই ওই তরুণী ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, যদি তার অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু ফতুল্লাপুরের সেই তরুণীর নাম কীভাবে হাজির হলো কালীবাড়ি রোডের ভোটার তালিকায়? তৃণমূল সব পারে, ভোটার তালিকা তাই বলছে। ওই বিধানসভার স্টেশন রোড পূর্বাংশের ভোটার তালিকার ৩৮৮নম্বরে একজনের নাম আছে, যার বাড়ির ঠিকানা ‘ওয়ার্ড নঙ্বর ৩’। একটি গোটা ওয়ার্ড ওই ব্যক্তির বাড়ি!
সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে শুধু দমদম উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের ৫৩৯৯জন মৃত ভোটার নাম নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়ে অবিলম্বে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। তাছাড়া স্থায়ীভাবে এলাকা ছেড়ে যাওয়া ১০৩২জন, কোনও খোঁজই নেই এমন ৬২৬জনের নাম কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। একই ভোটদাতার তালিকায় দু’বার নাম আছে, এমন অনেকের নামও দেওয়া হয়েছে কমিশনের কাছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment