ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। যদিও এই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে রাজ্য স্তরের নেতা-মন্ত্রীদের অতিরিক্ত বাচালতার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ভোটার তালিকায় সংশোধন অর্থাৎ নতুন ভোটারদের নাম তোলা এবং মৃত ও ভুয়ো ভোটারদের নাম ছেঁটে ফেলা নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক কাজ। একটি নিরপেক্ষ এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত সাংবিধানিক স্বাধীন সংস্থা হিসাবে নির্বাচন কমিশন একাজ করে থাকে। এখানে সরকার এবং শাসক দলের মাতব্বরির কোনও জায়গা নেই। রাজনৈতিক দল এবং রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্ব কমিশনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা যাতে নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করা যায়। তাছাড়া এসআইআর-ও নতুন কিছু নয়। দু’দশক আগে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এসআইআর হয়েছিল। বিহারেও হয়েছিল। কিন্তু কোথায় এমন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করা হয়নি। কমিশন তাদের পদ্ধতি মেনে সে কাজ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু এবার কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূল যেভাবে ময়দানে নেমে হইহট্টগোল করছে, একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ পালটা আক্রমণ করছে তাতে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর সন্দেহ দানা বাঁধছে।
কাজটা নির্বাচন কমিশনের। তাতে মোদী-শাহ কেন্দ্রীয় নেতা মন্ত্রীদের তো এত কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমিত শাহ এবং অন্যরা এমনভাবে কথা বলছেন যেন নির্বাচন কমিশন সরকারের অধীনস্ত সংস্থা। সরকারই কমিশনের নীতি ও কর্মপন্থা ঠিক করে দিচ্ছে। কমিশন মন্ত্রী তথা সরকারের হুকুম তামিল করছে। অবশ্য এটা ঠিক কমিশনার নিয়োগের আইন সংশোধন করে সরকারের অনুগত ও বাধ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে মোদী সরকার। ফলে নিযুক্ত কমিশনাররা মোদী-শাহদের পছন্দের লোক। এঁরা সরকারের মরজিমাফিক কাজ করলে অবাক হবার কিছু নেই। বস্তুত তেমনটাই ঘটছে। কমিশনের কাজ নিয়ে কমিশন যত কথা বলছে তার কয়েক গুণ বলছে নেতা-মন্ত্রীরা। যেন কমিশনের ঠিকাদারি নিয়েছে সরকার। বিজেপি’র রাজনৈতিক স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রেখে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে এসআইআর হচ্ছে দ্বিমত হবার কোনও জায়গা নেই।
বিজেপি’র রাজনীতির প্রধান অস্ত্র বিভাজন। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে যত তীব্র ও তীক্ষ্ণ করা যাবে ততই বিজেপি’র লাভ। তাদের লক্ষ্য সকল হিন্দুকে জোটবদ্ধ করে ভোটে মেরুকরণ নিশ্চিত করা। এসআইআর-কে তারা একাজে ব্যবহার করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এসআইআর মানে তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের প্রত্যেককে নতুন করে নাম তোলার আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন যাচাই করে মৃত, ভুয়ো, স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিতদের বাদ দেওয়া হবে। এভাবে নির্ভুল তালিকা হলে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারের সুতোয় টানা কাঠের পুতুলের মতো কশিন যদি শাসক দলে বিরূপ প্রকৃত ভোটারদের বাদ দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাহলে আপত্তি অবশ্যই করতে হবে।
লক্ষণীয় কমিশনের এই কাজের সঙ্গে সিএএ, অনুপ্রবেশ, বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা ইত্যাদি বাক্বিতণ্ডার কোনও সম্পর্ক নেই। কমিশনের মাপকাঠি অনুযায়ী যোগ্যরা ভোটার হবেন, অন্যরা বাতিল হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একদিকে বিজেপি অন্য দিকে তৃণমূল পরস্পরবিরোধী হুঙ্কার দিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে সকল নাগরিকদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি হয়। এটাই বিভাজনের কৌশল। রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি জিগির তুলে মুসলিমদের নাম বাদ দেবার চেষ্টা। প্রতিটি বুথে বামপন্থীদের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে যাতে প্রকৃত ভোটারের একটা নামও বাদ না যায়।
Editorial
এসআইআর’র আড়ালে

×
Comments :0