তৃণমূলের সব ঘোষণা কাগজে কলমেই
অনন্ত রায় 
বন বিভাগ এবং বন্য প্রাণীদের নিয়ে সরকারের যখন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া দরকার তখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে তিনি হাতির জন্য পুজো দেবেন!
হাতি জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসা। ট্রেনে কাটা পড়া নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই এই সব ঘটনা ঘটে আসছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেই সময় সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন উত্তরবঙ্গের জলদা পাড়া, গরুমারা, রাঢ় বঙ্গের বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়াতে বেড়েছিল হাতির সংখ্যা। লোকালয়ে হাতি ঢুকে পড়ার ঘটনাও বহু ঘটেছে। কিন্তু কেন বার বার হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে? সেই বিষয় প্রথম জোর দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সেই সময় দেখা যায় যে বিশাল সংখ্যক বনাঞ্চল যাকে এলিফ্যন্ট করিডোর বলা হয় সেখানে মানুষ বাড়ি করতে শুরু করেছে। থাকার জায়গা, খাবার না পেয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে হাতি। হাতি যাতে লোকালয়ে না ঢুকে যায়, তার জন্য বন দপ্তর তখন সিদ্ধান্ত নেয় যে এলিফ্যান্ট করিডোরে যেই অবৈধ নির্মাণগুলি হয়েছে সেই সব বাড়ি গুলি সরিয়ে ফেলার। তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়। জঙ্গলের মধ্যে যাতে হাতি তার নিজের খাবার জোগাড় করতে পারে তার জন্য বনাঞ্চলগুলিতে কাঁঠাল, চালতার মতো বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো হয়, যা হাতির পছন্দ। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে আরও গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি তৃণমূল সরকারের আমলে। উলটে গাছ কেটে চোরা কারবারি বেড়েছে।
                        
                        
হাতি লোকালয়তে প্রবেশ করলে সব থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো প্রান্তিক কৃষকদের। মাঠের ফসল নষ্ট করতো হাতির দল। ধান নষ্ট হতো। বছরের মাঝে ফসল নষ্ট হওয়া মানে একজন কৃষকে সারা বছর তার ফল ভুগতে হবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে হাতির হানায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের বিশেষ আর্থিক সাহায্যও করা হয়েছে। জঙ্গলে গাছ লাগানোর মতো এই ক্ষেত্রেও কৃষকদের দিকে কোনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি রাজ্য সরকার।
                        
                        
লোকালয়ে হাতি ঢুকে যাওয়া যেমন একটা সমস্যা অপর সমস্যা হচ্ছে ট্রেনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যু। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় বনের মধ্যে দিয়ে রেলের লাইন গিয়েছে। অনেক সময় একটা জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যু হয়। জয়রাম রমেশ কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রী থাকাকালীন এই বিষয় রেল মন্ত্রকের সাথে বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে রাজ্যের বন দপ্তরের আধিকারিকরাও ছিলেন। সেই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে লাইন পারাপার করতে গিয়ে যাতে কোনও বন্য প্রাণীর মৃত্যু না হয় তার জন্য রেলের পক্ষ থেকে পেট্রোলিং বাড়ানো হবে। বনের মধ্যে লাইন সংলগ্ন এলাকায় বসানো হবে ওয়াচ টাওয়ার, যাতে নজরদারি করতে সুবিধা হয়। ফ্লাইওভার তৈরির পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ট্রেন যাবে, তাতে ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর সম্ভাবনাও কমবে অনেকটা। তবে সেই সব পরিকল্পনা সব কিছুর মতোই কাগজে কলমেই রয়ে গিয়েছে। বাস্তবায়িত আর হয়নি। আর তাই এখন ‘উন্নয়ন’ এর বদলে পুজো করার পরিকল্পনা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
হাতির পথে লুটের পাহাড়
চিন্ময় কর
লোকালয়ে আবাসিক হিসাবে সারা বছর ধরে থেকে যাচ্ছে দলমার হাতির দল। পশ্চিম মেদিনীপুর  জেলার মেদিনীপুর সদর ব্লকের কংকাবতি, মণিদহ, চাঁদড়া, ধেড়ুয়া, শালবনী ব্লকের পীড়াকাটা, ভীমপুর, কলসিভাঙা, সিরসা, দেবগ্রাম এবং গোয়ালতোড় ব্লকের একাধিক এমন গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায়। ঝাড়গ্রাম জেলার মানিকপাড়া, জাম্বনী, গিধনি, লালগড়, সাঁকরাইল, গোপীবল্লভপুর এমন ব্লক গুলি সহ নয়াগ্রামের কিছু অংশে। এখন দুই জেলায় দলমা দলের হাতির সংখ্যা ২৮০ ছাড়িয়েছে। লোকালয় পর্যন্ত হাতির আনাগোনা এখন অনেক বেড়েছে। 
আগেও হাতির পাল আসতো আবার ফিরেও যেতো। সাধারণত বর্ষা নামলে সবুজ ঘন জঙ্গলকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন কাটিয়ে অন্যত্র চলে যেত। সঙ্গে শাবক থাকলে বা গর্ভবতী হাতি থাকলে প্রসবের জন্য পুরো দল একটি জঙ্গলকে কেন্দ্র করে সপ্তাহ জুড়ে থেকে যেত।
                        
                        
ছোটনাগপুর মালভূমির ঢাল এসে শেষ হয়েছে মেদিনীপুর শহরের ৫কিমি পশ্চিমে। ওডিশার ময়ূরভঞ্জ কিংবা দলমা থেকে হাতির পাল দুটি করিডর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করত। একটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সীমান্ত জামাইমারি সহ কাকড়াঝোড় ঘন জঙ্গল হয়ে আসত। আবার ওডিশার সীমান্ত নয়াগ্রাম ব্লক হয়ে সাঁকরাইল সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে সরাসরি মানিকপাড়া খালশিউলি হয়ে কাঁসাইনদী পেরিয়ে মেদিনীপুর সদর ব্লক চাঁদরা ধেড়ুয়া হয়ে আসত। এই চাঁদড়া ধেড়ুয়া হয়ে শালবনী গোয়ালতোড় হয়ে লালগড় ঝিটকা জঙ্গল পর্যন্ত হাতির করিডর গড়ে ওঠে। গোয়ালতোড় হয়ে বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরসহ গড়বেতার পর্যন্ত হাতির পালের করিডর বাড়তে থাকে। গত ১০ বছরে দলমা পথে হাতির করিডরে বদল হয়েছে।
                        
                        
ময়ূরভঞ্জ থেকে জামাইমারি পর্যন্ত মালভূমির একাধিক আস্ত পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মালভূমির চড়াই উতরাই মাঝে তৈরি হয়েছে গভীর খাদ। প্রসাশন ও শাসকদলের যৌথ মদতে গড়ে উঠেছে খনিজ পদার্থ লুটের সিন্ডিকেট বাহিনী। পাহাড় ফাটিয়ে লুট হয়েছে খনিজ তামা, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ আকরিক, ক্যালসিয়ামের মতো নানান ধাতব পদার্থ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘুর পথে দলমার হাতির পাল পশ্চিমবঙ্গের এই বনাঞ্চলে চলে এলেও ফেরার করিডরে এমন গভীর খাদ তৈরি হওয়ায় তারা আর দলমা ফিরে যেতে পারছে না। 
এই এগারো বছরে জঙ্গল লুট করে পাথর মোরাম খাদান হওয়ার ফলে জঙ্গলের পরিমাণ কমেছে ১৭ ভাগ। ঘন জঙ্গল আজ ফাঁকা হয়ে গেছে। নয়াগ্রাম ব্লকের জঙ্গল লুট হয়েছে। কাকড়াঝোড়, ঝিটকা, আরাবলী এমন বনজঙ্গল গুলি ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় হাতির পালের খাদ্য সঙ্কট যেমন বেড়েছে তেমনি লোকালয়ে ঢুকে তাণ্ডবও বেড়েছে। হাতির পাল ফিরে যেতে না পেরে এমন বনাঞ্চলে আবাসিক হয়ে থেকে যাওয়া এবং প্রতিবছর হাতির শাবকের সংখ্যা গড়ে ৪০-৫০টি করে জন্ম নেওয়ায় হাতির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু হাতির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগানের পরিকল্পনা না থাকায় সমস্যা প্রবল হয়েছে।
                        
                        
৩৩টি বীটসহ সাতটি রেঞ্জ দপ্তরে প্রয়োজনীয় বনকর্মী না থাকায় সীমান্ত এলালায় নজরদারি নেই। এক একজন রেঞ্জ অফিসারকে চারটি পাঁচটি অফিস সামলাতে হয় হাতে গোনা তিন চার জন কর্মী নিয়ে। ফলে বনকর্মী না নিয়োগ হওয়ায় সীমান্ত এলাকায় যেমন পাহাড় ফাটিয়ে গভীর খাদ তৈরি করে পাথর সহ খনিজ তামা লোহা লুট হচ্ছে অবাদে তেমনি সহজেই হাতির পাল ঐ দুই প্রতিবেশী রাজ্যতে তাড়া খেয়ে বাংলায় চলে আসছে। আর ফিরতে পারছে না।।
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0