তীব্র দহনে পুড়ছে রাজ্য। চলতি সপ্তাহে স্বস্তি মেলার কোনও লক্ষণ নজরে পড়ছে না। আগামীকাল থেকে টানা চারদিন কলকাতার পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের সব জেলায় তাপপ্রবাহ চলবে বলে আশঙ্কার কথা জানালো আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর। বুধবার আবহাওয়া দপ্তরে তরফে জারি করা হলো কমলা সতর্কতা। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকায় এদিন নবান্ন সূত্রে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে জারি হয়েছে এক নির্দেশিকা।
বুধবার কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা এই সময়ের গড় সর্বোচ্চ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। তবে পশ্চিমের জেলাগুলিতে এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে বৃহস্পতিবার তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হবে আগাম জানিয়ে দিয়েছে আলিপুর হাওয়া অফিস।
কলকাতাতেও আগামীকাল থেকেই তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বৃহস্পতিবার ৪০ ডিগ্রির গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, হাওড়া, হুগলী ও পূর্ব বর্ধমানের কিছু এলাকায় শুক্রবার তাপপ্রবাহের চূড়ান্ত প্রভাব দেখা যাবে। বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকায় এবার ঘাম কম হচ্ছে, ঘাম হলেও গা-হাত-পায়ে জ্বলুনি তৈরি হচ্ছে।
শনিবার পয়লা বৈশাখের দিন থেকে দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলায় শুরু হবে তাপপ্রবাহ। পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়ায় প্রবল গরম অনুভূত হবে। এই তাপপ্রবাহ চলবে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। নতুন বছরের শুরুতেই গরমের এই দফারফা অবস্থা দেখে অনেকের মনেই ইতিমধ্যে ভয় হতে শুরু করেছে। তপ্ত বৈশাখ এখনো বাকি। তার আগেই এমন উষ্ণতা চড়ে যাওয়া বেশ অস্বাভাবিক।
এই সময়ে আপাতত কোথাও বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই স্পষ্ট করে দিয়েছে হাওয়া অফিস। তাপপ্রবাহের সময় দক্ষিণবঙ্গের সব জেলার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি থাকবে। গরম থেকে বাঁচতে কী কী করতে হবে, কী কী করা চলবে না, সেই সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি করেছে নবান্ন। তপ্ত আবহাওয়ার জেরে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বাইরে না থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো স্কুলে যাওয়ার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি।
সার্চ লাইটের মতো রোদের মধ্যে যেসব কচিকাঁচাদের নিয়ে স্কুলে রওনা দিচ্ছেন অভিভাবকরা তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা দেখা যাচ্ছে। তবে বাড়তি গরমের জেরে অনেক জায়গায় আবাসনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘটঘটে রোদের জেরে সব্জি বাগানে আগুন লেগেছে। মাঠের তরতাজা সবজির গাছ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে টান পড়েছে আনাজের। সব সবজিই এখন বিকোচ্ছে চড়া দামে।
এদিকে, তীব্র তাপে পুড়ছে হুগলী। গতকাল গোঘাটে মাঠে ছাগল চড়াতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এক প্রৌঢ়ের। এর আগে নালিকূলে পুলিশি নাকার সময় বাইকে বসেই স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু হয়েছে অপর এক ব্যক্তির। এর মধ্যে ফের তাপমাত্রা আরো বাড়ার আশঙ্কার কথা জানানো হলো। তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় হুগলী জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ কর্মশালার। কয়েকদিন ধরেই ওই জেলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে।
মরুভূমির মতো শুষ্ক দাবদাহে পুড়ছে গোটা জেলা। তাপপ্রবাহ বিপজ্জনক হয়ে পড়ায় স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে লিফলেট বিলি শুরু হয়েছে। কি করবেন কি করবেন না, তাপ প্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর ও অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের তরফে জেলা প্রশাসনের কাছে আরজি জানানো হয়েছে। বুধবার হুগলী জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রমা ভুঁইয়া জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল, ব্লক হাসপাতালের আধিকারিকদের নিয়ে অনলাইন বৈঠক করেন। চুঁচুড়ায় জেলা হাসপাতাল থেকে তাপপ্রবাহ নিয়ে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এদিন জানান, নার্স, আশা কর্মী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্মীদের তাপপ্রবাহ নিয়ে কী কী সতর্কতা নিতে হবে তা এদিন পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন করার কাজও শুরু হয়েছে। সকাল এগারোটা থেকে বিকাল তিনটে পর্যন্ত চড়া রোদে বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হচ্ছে। যাঁদের না বেরোলেই নয়, তাঁদের শরীর ঢাকা দিয়ে মাথায় টুপি, চোখে রোদ চশমা পরার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
পোশাক ঢিলেঢালা সূতির পড়তে বলা হয়েছে। জল খেতে হবে বেশি করে। চা-কফি না বেশি না খেতে বলা হয়েছে। উপসর্গ দেখে কীভাবে ‘হিটস্ট্রোক’ বোঝা যাবে সেবিষয়েও জেলার সব হাসপাতালকে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। গরমের চিকিৎসা করতে জেলার স্বাস্থ্য জরুরি বিভাগ খুলতে বলা হয়েছে।
জলপাইগুড়িতেও তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। ওই জেলাতেও শুকনো গরমের তীব্রতা আগামীদিনে বাড়ার কথা বলা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমের জেরে নানান রোগ নিয়ে বুধবার প্রচুর মানুষকে ভিড় করতে দেখা গেছে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে। সকাল থেকে এসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ওষুধ নিতে দেখা গেছে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের। এবিষয়ে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ অসীম হালদার জানান, জেলায় সমস্ত হাসপাতালগুলোতে কর্মীরা তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। যেন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এবং সহজে সমস্যার সমাধান করা যায় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছ।
জলপাইগুড়িতে হঠাৎ করে এই শুষ্ক দাবদাহ একেবারে নতুন। তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনভ্যস্ত জেলার সাধারণ মানুষকে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন কিংবা নুন-চিনির জল বারেবারে খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক। হুগলীর মতো জলপাইগুড়িতেও জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে সচেতনামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ব্লক, মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসতে অনুরোধ করা হয়েছে। গরমে হালকা সহজ পাচ্য খাবারের পাশাপাশি বেশি করে জল পানের ওপর জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
Comments :0