অয়নাংশু সরকার
‘নওজোয়ান ভারত সভা’ শতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে। ১৯২৬-এর মার্চে লাহোরে এই সংগঠন তৈরি হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগী বিপ্লবীরা। আজ লাহোরে পৌঁছাতে পাসপোর্ট লাগে। মাঝে কাঁটাতার, দেশভাগের স্মৃতি এবং যন্ত্রণা। কিন্তু ‘নওজোয়ান ভারত সভা’ যে আদর্শ, কর্মসূচি প্রায় একশো বছর আগে অবিভক্ত ভারতের সামনে পেশ করেছিল, তা আজও অম্লান। কোনও কাঁটাতার তাকে ছিন্নভিন্ন, বিভাজিত করতে পারবে না। 
১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশন থেকে ইংরেজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করবার সিদ্ধান্ত হয়। দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। দু’ বছরের মাথায় মহাত্মা গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। ১৯২২ সালে গোরখপুরের চৌরিচৌরা গ্রামে ক্ষুব্ধ মানুষের থানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। অসহযোগ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি করেছিল স্বাভাবিকভাবেই তা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবীদের একাংশ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামপ্রসাদ বিসমিল একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন যার নাম হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (মতান্তরে আর্মি)। সূর্য সেন সহ অবিভক্ত বাংলার অনেক সশস্ত্র সংগ্রামীও সেই সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, সুকদেব, রাজগুরু, বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন দাস, আশফাকউল্লা খান, শিব বর্মা, রোশন সিং, রাজেন্দ্র লাহিড়ী প্রমুখও এই সংগঠনে জড়িত ছিলেন।
১৯২১ সালে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মৌলানা হসরত মোহানি ও স্বামী কুমারানন্দ ‘পূর্ণ স্বাধীনতার’ দাবি তোলেন। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন(এইচআরএ)-এর সদস্যরাও পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যেই বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ১৯২০ সাল পরবর্তী সময়ে গান্ধীজীর সঙ্গে এইচআরএ’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শচীন্দ্রনাথ সান্যালের কথা হয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় নিয়ে। স্বাধীনতার পথ নিয়ে মতাদর্শগত বিরোধ বাধে গান্ধীজী ও শচীন্দ্রনাথ সান্যালের মধ্যে। এই ঘটনা ইয়ং ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত হয়। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল তার আত্মজীবনী ‘বন্দী জীবন’-এ লিখেছেন,‘‘১৯২৩ সালে কংগ্রেসের দিল্লি অধিবেশনের পরই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার সংগঠনের নাম ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ এবং সংগঠনের সম্পূর্ণ নিয়মাবলীও প্রস্তুত করতে শুরু করে দিয়েছিলাম।’’
১৯১৭ সালে সোভিয়েতের বিপ্লবের সাফল্য ও এই বিপ্লবে জনগণের জয় তরুণ বিপ্লবীদের মনে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যা সোসিয়েশনের সদস্যদের মধ্যেও সোভিয়েতের বিপ্লবের প্রভাব ছিল। ১৯২৫ সালে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এক ইস্তেহারে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভারতের রাজ্যসমূহের এক সংযুক্ত সাধারণতন্ত্র গঠনের দাবি ঘোষণা করে। রুশ বিপ্লবের সুস্পষ্ট প্রভাবেই তারা জনপরিষেবামূলক যাবতীয় জাতীয় সম্পত্তি– ইস্পাত শিল্প, নৌ বাণিজ্য শিল্প, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই জাতীয়করণের দাবি জানাতে শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের দিকে এগিয়ে চলার এই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মাবলির মধ্যে লেখা হয়েছিল,‘‘এই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্দেশ্য হবে সংগঠিত ও সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফিডারেটেড প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।’’ শচীন্দ্রনাথ সান্যালের উদ্যোগে ‘দা রিভলিউশনারি’ নামে একটি ইশ্তেহার ও প্রকাশ করে এইচআরএ । এই ইশ্তেহারে স্বাধীন ভারত গড়ার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। তাঁদের কার্যক্রম চালানো এবং অস্ত্রশস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা ৮ আগস্ট, ১৯২৫ তারিখে শাহজাহানপুরে একটি সভায় বসেন। সিদ্ধান্ত হয় যে তারা সরণপুর লক্ষ্মৌ চলাচলকারী ৮-ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন বহনকারী সরকারি কোষাগার লুট করবেন। ৯ আগস্ট ১৯২৫ তারিখে কাকোরিতে আসফাকউল্লা খান, রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, রোশন সিং, শচীন্দ্রনাথ বক্সী, চন্দ্রশেখর আজাদরা ট্রেন লুট করেন। ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন রামপ্রসাদ বিসমিল, ১৯২৬ সালের ১৭ জুলাই দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার হন আশফাকউল্লাহ খান। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৪০ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। কাকোরি ট্রেন ডাকাতির সময় উত্তর প্রদেশেই ছিলেন সূর্য সেন। ১৯২৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে ধরপাকড় শুরু হলে মাস্টারদা চলে আসেন কলকাতায়। পরে আবার ফিরে যান উত্তর প্রদেশে জেল ভেঙে সহযোদ্ধাদের মুক্তির পরিকল্পনা সফল করতে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯২৬ সালের ১ মে স্পেশাল সেশন আদালতে বিচারপতি এন্ড্রু হ্যামিলটনের অধীনে শুরু হয় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯২৭ সালের ৬ এপ্রিল চূড়ান্ত রায়ে রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লাহ খান, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, রোশান সিং-কে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় ও শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। বাকি বিপ্লবীদের কাউকে ১০ বছর কাউকে ১৪ বছর কাউকে ৭ বছরের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়। কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলার শুনানির সময় আদালতে নিয়মিত হাজির থাকতে দেখা যায় ভগৎ সিংকে। অভিযুক্তদের অন্যতম যোগেশ চ্যাটার্জি তাঁকে চিনতেন। তিনি ভগৎ সিংকে বন্দিদের আদালতে আনার সময় রাস্তার ধারে, শুনানির সময় আদালতে একদম সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখেন দিনের পর দিন।
এই সময়েই ভগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে ১৯২৬-এর মার্চে লাহোরে তৈরি হয় একটি বিপ্লবী যুব সংগঠন ‘নওজোয়ান ভারত সভা’। অর্থাৎ কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলাকালীনই লাহোরে তৈরি হয় ওই সংগঠন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হলেন ভগৎ সিং, সভাপতি রামকৃষন। এছাড়াও সুকদেব, ভগবতী চরণ ভোরা, সাইফুদ্দিন কিচলু, মীর আব্দুল মজিদ, শারদুল সিং প্রমুখরা ছিলেন সংগঠনের সদস্য। এটি ছিল কার্যত গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকাশ্য মঞ্চ। ছোট ছোট সভা, বক্তৃতা, ইশ্তেহার বিলির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও বিপ্লববাদের প্রচার শুরু করলেন বিপ্লবীরা। নওজোয়ান ভারত সভার সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বিপ্লবী শহীদদের জীবনী ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে দেখাতেন গ্রামের মানুষের চেতনা বৃদ্ধির জন্য। কেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে সে সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করতেন নওজোয়ান ভারত সভার বিপ্লবীরা। নওজোয়ান ভারত সভা দ্রুত দিল্লি এবং অন্যান্য রাজ্যে প্রসার লাভ করে। ভগবতী চরণ ভোরা, ভগৎ সিং, মীর আব্দুল মজিদ কীর্তি কিষান পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । কীর্তি কিষান পার্টির প্রতিষ্ঠায় জড়িত ছিলেন গদর পার্টির প্রতিনিধি বাবা ভাগ সিং কানাডিয়ান (যিনি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন), গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি ফিলিপ স্প্রাট (যিনি পরবর্তী কালে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন) , মোহন সিং জোশ প্রমুখ। এই পার্টির মুখপাত্র কীর্তি পত্রিকায় উর্দু সংস্করণ প্রকাশে কিছুকাল কাজ করেছিলেন ভগৎ সিং। এই যোগাযোগই আসলে তার প্রাথমিক চেতনা গড়ে ওঠায় সহায়ক হয়েছিল। ওই সময়ই ভগৎ সিং লিখছেন ‘‘কমিউনিজমের জন্মদাতা কার্ল মার্কসের কিছু লেখা এবং প্রচুর পরিমাণে লেনিন ও ট্রটস্কির লেখা পড়ে ফেললাম।’’ ভগৎ সিং আরও লেখেন,‘‘১৯২৬ সাল শেষ হবার আগেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে জগতের স্রষ্টা, দাতা ও নিয়ামক এক সর্বশক্তিমান পরম শ্রদ্ধার অস্তিত্বের ধারণা ভিত্তিহীন।’’ পরবর্তী সময়ে নওজোয়ান ভারত সভার বিপ্লবীরা রুশ বান্ধব সপ্তাহ পালন করেন। এর থেকে স্পষ্ট হয় সোভিয়েতের বিপ্লব বিপ্লবীদের মনে প্রভাব ফেলেছিল। 
স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে দেশের সব কটি বিপ্লবী গোষ্ঠীকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন ভগৎ সিংরা। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলাতে ১৯২৮ সালের ৮ এবং ৯ সেপ্টেম্বর এক ঐতিহাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দু’দিন সভা পরিচালিত হয়। সভাতে নির্দিষ্ট হয় হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নামের সঙ্গে সোশালিস্ট শব্দ যুক্ত হয়ে ‘হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (এইচএসআরএ) হবে। সভার দ্বিতীয় দিন সাত সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। সেই সাতজন হলেন ভগত সিং, সুখদেব, বিজয় কুমার সিনহা, শিব বর্মা, ফণিন্দ্রনাথ ঘোষ, কুন্দনলাল, চন্দ্রশেখর আজাদ (চন্দ্রশেখর আজাদ অনুপস্থিত ছিলেন কারণ সেই সময় তিনি কাকোরি বড়যন্ত্র মামলায় ফেরার আসামি)।
সম্মেলন থেকে সাইমন কমিশনকে বয়কট করার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবার সিদ্ধান্ত হয়। দেশ জুড়ে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু হয়। লাহোরের মাটিতে নেমেছিল প্রতিরোধের মিছিল। স্কটের নেতৃত্বে মিছিলের উপর লাঠিচার্জ হয়। পুলিশের লাঠির আঘাতে ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন লালা লাজপত রায়। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নেয় লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেবার। ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা ভুলবশত জেপি স্যানডার্স-কে গুলি করে হত্যা করেন বিপ্লবীরা। সকল বিপ্লবীরাই আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে ধারাবাহিক পরিচালনা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ১৯২৯ সালে দুটি জনবিরোধী বিল যথা পাবলিক সেফটি বিল ও ট্রেড ডিসপিউট বিলকে আইনে পরিণত করবার উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টায় দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভার এই দুটি জনবিরোধী বিল আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় সভার মধ্যে বোমা নিক্ষেপ করেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত। তাঁরা স্লোগান দেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।’ তাঁরা ছড়িয়ে দেন সংগঠনের ইশ্তেহার।  শুকদেব, রাজগুরু, শিব বর্মা, কিশোরী লাল, জয়দেব কাপুর, মহাবীর সিংহ সহ ২৭ জন বিপ্লবীকে আসামি করে শুরু হয় ইতিহাসের কুখ্যাত লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। বিচারের শেষে ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেবের ফাঁসির হুকুম হয়। 
‘হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ কিংবা ‘নওজোয়ান ভারত সভা’র বিপ্লবীরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সুগভীর সহানুভূতি, জাতীয় সংহতি এবং সুদৃঢ় একাত্মবোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে দেশ থেকে তাড়ানো নয়, তার সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা ছিল তাঁদের লক্ষ্য। ১৯৩০ সালের ২১ জানুয়ারি লেনিনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীরা লেনিন দিবস পালন করেন। ভগৎ সিং সহ নওজোয়ান ভারত সভার বিপ্লবীরা ঘোষণা করেছিলেন ‘আমরা সমাজতন্ত্র চাই’।       
আজ এক কঠিন সময়ে যখন সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ বাড়ছে, সাম্রাজ্যবাদ যখন ঐক্য বিনষ্টকারী শক্তি গুলিকে মদত জোগাচ্ছে, স্থায়ী কাজের জায়গা যখন ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে , শিক্ষার উপর যখন আক্রমণ চলছে, তখন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে ‘নওজোয়ান ভারত সভা’র বিপ্লবীদের লড়াই সংগ্রামের ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আজকের যুব সমাজের কাছে তাদের রাজনৈতিক ভাবনাকে নিয়ে যাওয়া এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিপ্লবীদের অন্যতম আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি। ভগত সিং জেলে বসে ভারতের মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিপ্লবী কর্মসূচির খসড়াতে জমির জাতীয়করণ, বসবাসের জন্য আবাসনের গ্যারান্টি, কৃষকের ঋণ মকুবের কথা বলেছিলেন। তার সঙ্গে শ্রমিকের কাজ ও কাজের সময় সম্পর্কে, কারখানা জাতীয়করণ ও সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলেছিলেন। ভগৎ সিং এবং তার কমরেডরা জানিয়েছিলেন,‘‘আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায়, তবে মানব সভ্যতার পরিণতি বড় ভয়ানক।’’
শিক্ষানীতি সম্পর্কে, কাজের অধিকার সম্পর্কে, সম্পদের জাতীয়করণ সম্পর্কে ভগৎ সিংদের বক্তব্য অনেকাংশেই আজও প্রাসঙ্গিক। আজও ভারতবর্ষের মাটিতে বেকারের কাজের দাবিতে, সকলের শিক্ষার দাবিতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে বিক্রির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে  লড়াই চলেছে। এই লড়াই সংগ্রামের পথেই বিদ্যুৎ, মইদুল, মনসুর, রাজিবুলরা শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন। যে চরম সঙ্কট চলছে আমাদের দেশে, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে শামিল হচ্ছেন। সেই ঐক্য ভাঙতে ধর্মীয়, সম্প্রদায়গত, জাতিগত বিভাজনের অপচেষ্টা প্রতিদিন চলছে। ‘নওজোয়ান ভারত সভা’র বিপ্লবীদের লড়াই এবং অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অনেক পথ এগতে হবে। ভগৎ সিংদের মতো বিপ্লবীদের উত্তরাধিকারীরা সেই পথ পেরোবেই - পেরোতেই হবে। কারণ লক্ষ্য সমাজতন্ত্র।
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0