এবার আর শুধু মুখের কথায় নয়, রীতিমতো তথ্য এবং পরিসংখ্যান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তোগ দাগলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। বিজেপি’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে লোকসভা ভোটের সময় ব্যাপক কারচুপি করেছে কমিশন বলে গুরুতর অভিযোগ করতে দ্বিধা করলেন না তিনি। কংগ্রেস নেতা কথা দিয়েছিলেন, অন্তর্তদন্তের রিপোর্ট পেশ করে ‘পারমাণবিক বোমা’ বিস্ফোরণ ঘটাবেন। বৃহস্পতিবার কংগ্রেসের সদর দপ্তর ইন্দিরা ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে সেই রিপোর্ট পেশ করে অভিযোগ করেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন ‘সাংবিধানিক বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে এবং পরিকল্পিতভাবে ‘ভোট চুরি’ করে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। ভোটার তালিকায় বিপুল পরিমাণ ভুয়ো ভোটারের নাম তোলা হয়েছে বলেও পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। এপ্রসঙ্গে তিনি কর্নাটকের বেঙ্গালুরু মধ্য লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহাদেবপুরা বিধানসভা আসন এবং সামগ্রিকভাবে মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার ভোটার তালিকার জালিয়াতির কথা তুলে ধরেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই রাহুল গান্ধীর অভিযোগ সম্পর্কে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি। কংগ্রেস সাংসদকে চিঠি দিয়ে কমিশন রীতিমতো হুমকির সুরে বলেছে, ‘তিনি যদি ভোটারদের নাম, ঠিকানা ও পরিচয় দিয়ে কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে থাকেন তাহলে তিনি যেন তাতে ‘হলফ করে সত্যি কথা বলছি’ বলে স্বাক্ষরের পাশাপাশি অভিযোগের প্রমাণ দাখিল করেন। অন্যথায় তিনি যেন অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। কোনওভাবেই জনগণকে বিভ্রান্ত করার অধিকার তাঁর নেই।’ কার্যত লোকসভার বিরোধী দলনেতাকে মুচলেকা দিতে বলেছে কমিশন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকিও দিয়েছে। আবার বিজেপি লোকসভার বিরোধী দলনেতার অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ‘উনি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন’ বলে কটাক্ষও করেছে। পরে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্য পালটা জবাব দিয়ে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘আমি একজন নেতা। আর আমি সর্বসমক্ষে এ কথা বলেছি। আমার অঙ্গীকার এটাই।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘আমি আমার মনগড়া কোনও তথ্য দিইনি। এটা কমিশনেরই তথ্য। আবার কমিশন কিন্তু এই তথ্য বা পরিসংখ্যানকে খারিজ করে দেয়নি। ওরা একবারও বলছে না, রাহুল গান্ধী যে কথা বলছেন, তার সবটাই ভুল।’’
কমিশন কিংবা বিজেপি রাহুল গান্ধীর অভিযোগ সম্পর্কে সহমত না হলেও কংগ্রেস সাংসদ বস্তুত কমিশনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ‘বড় ধরনের গরমিল বা কারচুপি’র অভিযোগ করেছেন। এদিন তিনি হিন্দি এবং ইংরেজিতে উপস্থাপনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে লক্ষ লক্ষ ভোট কারচুপি করে ফলাফল বিজেপি’র পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাদেবপুরা বিধানসভা আসনের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন যে, ওই কেন্দ্রের ৬.৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে অন্তত ১ লক্ষ ভোট জালিয়াতি করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, একই ব্যক্তির নাম পৃথক পৃথক বুথে নথিভুক্ত আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভোটারের ছবি নেই। আবার জাল ভোটারের নামও তোলা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘তাঁরা প্রথমে কমিশনের দ্বারস্থ হয়ে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কমিশন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় আমরা অন্তর্তদন্ত শুরু করি। কংগ্রেসের ৩০-৪০ জন গবেষকের বিশেষ দল একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত গিয়ে নথিপত্র ঘেঁটে, যাচাই করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। তাতে পাঁচ ধরনের গলদ একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই পাঁচটি ধরন হলো; ১) একই নাম একাধিকবার-১১, ৯৬৫, ২) ভুয়ো ও অস্তিত্বহীন ঠিকানা-৪০,০০৯, ৩) একই ঠিকানায় বিপুল সংখ্যক ভোটার-১০,৪৫২, ৪) অস্বচ্ছ বা ভুল ছবি-৪,১৩২ এবং ৫) ফরম ৬-এর অপব্যবহার-৩৩,৬৯২। নির্বাচন কমিশনের কাছে দুটি প্রশ্নও করেছেন রাহুল গান্ধী। ১) কেন ডিজিটাল ভোটার তালিকা দেওয়া হচ্ছে না? ২) কেন ভোটার তালিকায় এত বেশি ভুয়ো ভোটার? তাঁর বক্তব্য, ‘‘ডিজিটাল তালিকা দেওয়া হলে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে জালিয়াতি ধরা পড়ে যাবে। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজের নিয়মও বদলে ফেলা হয়েছে যাতে ভোটের দিন সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ সম্ভব না হয়।’’
অন্তর্তদন্ত সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যাও দেন রাহুল গান্ধী। তিনি জানান, ‘‘তাঁদের গবেষক দল তদন্ত চালাতে গিয়ে দেখেছে গুরকিরত সিং ডাং নামের এক ব্যক্তির নাম ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানায় চারটি বুথে তালিকাভুক্ত। আদিত্য শ্রীবাস্তব নামের এক ব্যক্তির নাম মহাদেবপুরার দুটি বুথের পাশাপাশি লক্ষ্ণৌ এবং মুম্বাইয়ের ভোটার তালিকাতেও আছে। এই ধরনের ঝুরি ঝুরি অভিযোগ আছে। আবার এমন ভোটারও পাওয়া গিয়েছে যাঁদের ‘বাড়ির ঠিকানা ০, রাস্তার নম্বর ০’। বুথ ৩৬৬-তে একই ঘরে ৪৬ জন ভোটারের নাম আছে। তদন্তে দেখা যায়, ওটা একটাই ঘর এবং ওখানে কেই বসবাস করেন না।’’ ভুয়ো ছবি প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা বলেছেন, ‘‘শকুন রানি নামের ৭০ বছর বয়সী এক ভোটার দু’মাসের ব্যবধানে দু’বার নাম নথিভুক্ত করেছেন। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ছবি এমনভাবে বদলানো হয়েছে যাতে দেখে দুজনকে আলাদা ব্যক্তি বলে মনে হয়। এমনও ছবি আছে যা দেখে চেনার উপায় নেই। কারোর বাবার নামের জায়গায় অদ্ভুত সব অক্ষর লেখা!’’ তিনি জানান, ‘‘বেঙ্গালুরু মধ্য কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী মনসুর আলি খান গণনার বেশিরভাগ সময় এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হতেই দেখা গেল বিজেপি প্রার্থী পিসি মোহন ৩২, ৭০৭ ভোটে জয়ী হয়েছেন।’’ কংগ্রেস সাংসদ বলেন, ‘‘১ লক্ষ ভোট জালিয়াতির ফলে এমন ফলাফল।’’ তিনি জানান, ‘‘কর্নাটকে অন্ততপক্ষে ১৬টি আসন জেতার কথা ছিল কংগ্রেসের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন সব কারচুপির ফলে ৯টি আসন পায়।’’ এমনও অভিযোগও করেছেন তিনি, ‘‘১১ হাজারেরও বেশি ভোটার তিন বার করে ভোট দিয়েছেন।’’ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘‘দেশের মানুষকে আমরা এটাই বোঝাতে চাইছি যে, এটাই ভবিষ্যৎ। গোটা ব্যবস্থাকে চুরি করা হচ্ছে। এই তথ্য ১০০ শতাংশ স্বচ্ছ এবং নির্ভুল।’’
মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে ব্যাপক গরমিলের অভিযোগ অনেকদিন ধরেই করে আসছিলেন রাহুল গান্ধী। এদিনও বেঙ্গালুরুর মধ্য লোকসভা আসনের অন্তর্তদন্তমূলক রিপোর্ট উল্লেখের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা ভোটে কারচুপির অভিযোগও করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘ওখানকার বিধানসভা ভোটের ফলাফল মোটেই সঠিক নয়। লোকসভা ভোটে ওই রাজ্যে ৪৮টির মধ্যে ৩০ আসন জিতেছিল ইন্ডিয়া মঞ্চ। অথচ পাঁচ মাস পরেই বিধানসভা ভোটে ৫০ আসনও জিততে পারল না বিরোধীরা! পাঁচ মাসে যত ভোটারের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তালিকায় যা পাঁচ বছরেও হয়নি। ৪০ লক্ষেরও বেশি ভোটারের নাম যুক্ত করা হয়েছে। আবার ভোটের পর কমিশনে অভিযোগ জানালে দাবি করা হয়েছে যে, বিকেল ৫.৩০ মিনিটের পরেও বহু ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের পোলিং এজেন্টরা জানিয়েছেন যে, এমন কোনও ঘটনা তাঁদের নজরে আসেনি। যেমন ভোট হওয়ার তেমনই হয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের দিন যে ভোট পড়ার হার জানানো হয়েছে, পরে তা সংশোধন করে অনেকটাই বাড়িয়ে বলেছে কমিশন। প্রচুর অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। বস্তুত, মহারাষ্ট্র ভোটের পরেই আমরা বুঝতে পারি, কিছু গরমিল চলছে গোটা ব্যবস্থায়।’’ ভোটার তালিকা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের জবাব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘২০২৪ সালের হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মাত্র ৮টি আসনে হেরে যায়, যেখানে মোট ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২২,৭৭৯। অথচ গোটা রাজ্যে মোট ভোটার ছিল ২ কোটি।’’ তিনি বলেন, “এই ফলাফল শুধু অভূতপূর্ব নয়, অতিবাস্তব। আমাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা, বুথফেরত সমীক্ষা ও বাস্তব ফলের মাঝে চরম বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গিয়েছে।’’ একই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি মধ্য প্রদেশের বিধানসভা ভোটের ফল নিয়েও।
নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে তিনটি দাবিও জানানো হয়েছে কংগ্রেসের পক্ষ। এপ্রসঙ্গে রাহুল গান্ধী বলেছেন তাঁরা চান; ১) ডিজিটাল ভোটার তালিকা প্রকাশ, ২) ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ এবং ৩) নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে ভোটার তালিকার তদন্ত।
এর পরই নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে কংগ্রেস সাংসদ বলেছেন, ‘‘আপনার যে পদেই থাকুন না কেন, সিনিয়র হোন বা জুনিয়র, আপনাদের রেয়াত করা হবে না। আপনারা দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে পারেন না। গণতন্ত্রকে রক্ষা করাই আপনাদের কাজ।’’
পয়েন্টস: ১
মহাদেবপুরায় ভোট চুরির পাঁচ ধরন:
১) একই নাম একাধিকবার-১১, ৯৬৫
২) ভুয়ো ও অস্তিত্বহীন ঠিকানা-৪০,০০৯
৩) একই ঠিকানায় বিপুল সংখ্যক ভোটার-১০,৪৫২
৪) অস্বচ্ছ বা ভুল ছবি-৪,১৩২
৫) ফরম ৬-এর অপব্যবহার-৩৩,৬৯২
পয়েন্টস: ২
কমিশনের কাছে প্রশ্ন:
১) কেন ডিজিটাল ভোটার তালিকা দেওয়া হচ্ছে না?
২) কেন ভোটার তালিকায় এত বেশি ভুয়ো ভোটার?
পয়েন্টস: ৩
কংগ্রেসের দাবি:
১) ডিজিটাল ভোটার তালিকা প্রকাশ
২) ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ
৩) নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে ভোটার তালিকার তদন্ত
Comments :0