রণদীপ মিত্র : সিউড়ি
বাবা ভারতের বাসিন্দা। মা’ও তাই। দু’জনেই বাংলায় কথা বলেন। দু’জনেরই নাম আছে ২০০২’র ভোটার তালিকায়। দাদুর নাম ১৯৮৩ সালের ভোটার তালিকাতেও আছে। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবিকে ‘পুশব্যাক’ করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি হয়ে গিয়েছেন ‘বাংলাদেশি’!
বীরভূমের প্রত্যন্ত জনপদ পাইকরের দর্জিপাড়া থেকে সপরিবারে দানিশ সেখ, সোনালি বিবি, সুইটি বিবিরা পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লি। ভাংরির বেচাকেনা করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছিলেন তাঁরা। আচমকা এই দুই পরিবারের ৬ জনের খোঁজ মিলছিল না। পরে জানা যায়, গত ১৮ জুন দানিশের পরিবারকে আটক করেছিল দিল্লি পুলিশ। ২৬ জুন তাদের বিএসএফ’র মাধ্যমে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। কী ছিল অভিযোগ? বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশি!
বাংলাদেশে পাঠানোর পর ‘পুশব্যাক’র শিকার এদেশের এই ৬ জনকে গত ২০ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর মডেল থানার পুলিশ ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে গ্রেপ্তার করে। সেই থেকেই বাংলাদেশের জেলেই রয়েছেন তাঁরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিজেএম আদালতে ফের শুনানি হবে ৬ নভেম্বর।
নির্বাচন কমিশনের জারি করা নির্দেশ অনুসারে ২০০২’র ভোটার তালিকায় মা কিংবা বাবার নাম থাকলে সন্তান অবধারিতভাবেই বৈধ ভোটদাতা। সোনালি বিবির বাবার নাম ভোদু সেখ। ২০০২ ও ২০২৫ দুই ভোটার তালিকাতেই জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। ২০০২ সালের ভোটার তালিকা ঘাঁটলেই দেখা যাবে ২৯৪-মুরারই বিধানসভা কেন্দ্রের অধীনে রয়েছে ১৪৮ নং অংশের ভোটারদের তালিকা। তাতে ৫০৮ ক্রমিক নম্বরে রয়েছে ভোদু সেখের নাম। সোনালি বিবির মা জ্যোৎস্না বিবিরও নাম রয়েছে সেই তালিকারই ক্রমিক নম্বর ৫০৯’এ। শুধু তাই নয়, সোনালির দাদু হাতেম তাই সেখের নামও রয়েছে সেই তালিকার ৫০৬ নম্বরে। পরিবারের দাবি, হাতেম তাই সেখের নাম ১৯৮৩ সালের ভোটার তালিকাতেও আছে। আবার ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা ঘাঁটলেও মিলে যাবে ভোদু সেখ, জ্যোৎস্না বিবি এবং সোনালির দাদা সুরজ সেখের নাম। একই বিধানসভাতেই রয়েছে তাঁদের নাম। অংশের নম্বর পালটে হয়েছে ২৩৪। সেই অংশের ২২৭ ক্রমিক নম্বরে জ্বলজ্বল করছে সোনালির বাবা ভোদু সেখের নাম। সেই অংশেই মিলে যাবে সোনালির পরিবারের বাকি সদস্যদের নাম। তাহলে দাঁড়ায়, পরিবারের সবাই ভারতীয়, আর সোনালি বাংলাদেশি!
পাইকরের ফকিরপাড়ার বাসিন্দা সোনালি বিবিদের সঙ্গে একই কারণে বাংলাদেশের জেলে রয়েছেন একই এলাকার দর্জিপাড়ার বাসিন্দা সুইটি বিবিও। তাঁর দুই নাবালক সন্তানও রয়েছে জেলে। সুইটি বিবির মা লাজিনা খাতুনের নামও রয়েছে ২০২৫’র তালিকায়। তাঁর ভোটার পরিচয়পত্রের নম্বর আইইআর ১৫৫২২২৩। তিনি মুরারই বিধানসভার ২৩১ অংশের ভোটার। ক্রমিক নম্বর ২৪৫। অথচ খেটেখাওয়া এই দুই পরিবারের ৩ নাবালক সহ ৬ জনের ঠাঁই এখন বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলে। প্রসবের দিন এগিয়ে আসছে সোনালি বিবির। স্বাস্থ্য পরিষেবা আদৌ পাচ্ছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়।
গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ আদালত তাঁদের ভারতীয় ঘোষণা করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিল, এঁদের সকলকে স্বদেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের তরফে আগেই কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিল। আদালত গত ২৬ সেপ্টেম্বর চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের দেশে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। সেই চার সপ্তাহও উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এগোয়নি পরিযায়ী শ্রমিক এই দুই পরিবারকে দেশের ফেরানোর কোনও পদক্ষেপ।
সোনালি বিবিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ও আইনি পদক্ষেপের তত্ত্বাবধান করতে বাংলাদেশে ছুটে যাওয়া মফিজুল সেখ জানিয়েছেন, ‘‘আগামী ৬ নভেম্বর ফের মামলার শুনানির দিন ধার্য আছে। সেদিন আদালতে কি হয় দেখা যাক। সকলেই খুবই বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছেন। দেখা হয়েছিল তাদের সঙ্গে আদালতে ও জেলে। সকলেরই একই প্রশ্ন, কবে দেশে ফিরবেন।’’
দেশ তো তাঁদের ভারতই। তাই দেশে ফিরতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের দেশে ফেরানো আটকাতে কেন্দ্রের সরকার যে মরিয়া। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে কেন্দ্র। সোনালি বিবির ভাই সুরজ সেখের কথায়, ‘‘আমরা ভারতীয় আর কিভাবে প্রমাণ দিতে হবে জানি না। হয়তো সোনালিদের ভোটার লিস্টে এখনও নাম ওঠেনি। আমাদের সবার তো আছে। ওরাও আবেদন করেছিল। কিন্তু বাইরে বাইরে খেটে খেতে গিয়ে এব্যাপারে তদারকি করা হয়নি।’’
Comments :0