Post Editorial

এইমস-এ চিকিৎসার বদলে মন্দিরের চরণামৃত!

উত্তর সম্পাদকীয়​

দীপক নাগ


শাসকশ্রেণি সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবে। তাই ওরা সাধারণ মানুষের নাক কেটে তার বদলে নরুণ উপহার দিতে চায়। বলা যেতে পারে গোরু মেরে জুতো দান করে। সেভাবেই মমতা ব্যানার্জির সরকার বাংলার মানুষদের ঠকাচ্ছে। বীভৎস প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মহাকাল মন্দির স্থাপনের নাম করে উত্তরবাংলার মানুষকে মুখ্যমন্ত্রী উপহাস করছেন। ঘরবাড়ি সহ জীবনের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত হারিয়ে শ'য়ে শ'য়ে মানুষ মাঠেঘাটে আস্তানা করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ওঁদের ঘর নেই, খাবার নেই, জল নেই, শিশুদের দুধ নেই, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার বই-খাতা নেই, ওষুধ নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। মাঝে মাঝেই উত্তরবাংলার মানুষকে এই অবস্থার শিকার হতে হয়। প্রধান কারণ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া। পাহাড় থেকে নেমে আসা ১৫০টির বেশি নদী, উপনদী ও শাখানদীগুলো সবই পাথর ও বালিতে ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে। সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে পাথর বা বালি চুরির দিকে যত যত্ন নেওয়া হয়, তার সামান্য পরিমাণ যত্নও নদীগুলোর নাব্যতা বাড়ানোর জন্য করা হয় না। 
বিধ্বংসী বন্যার পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সদম্ভে ঘোষণা করলেন, উত্তরবঙ্গবাসী যাতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে পারেন তার জন্য রাজ্যের সবচাইতে বড় মহাকাল বা শিব মন্দির করে দেওয়া হবে। কোচ রাজাদের সময় থেকেই 'শিব' এখানে 'মহাকাল' নামে পূজিত হয়ে আসছে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বহু পুরানো শতাধিক মহাকাল মন্দির আছে। মহাকাল নামে অনেক জায়গার নামও দেখা যায়। আগামী নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা। পশুপতি বা শিব বা মহাকাল উত্তরবঙ্গের এক অংশের নেপালি ও বাঙালিদের উপাস্য দেবতা। বিজেপি ও সংবাদ মাধ্যম সহ স্বার্থান্বেষীরা সবাই খুশি। বিজেপি’র খুশি না হওয়ার কারণ নেই। বিজেপি’র বেশিরভাগ নেতা-কর্মীই প্রাক্তন তৃণমূলী। আবার বিজেপি-ফেরত তৃণমূলীদের সংখ্যাও কম নয়। মমতা ব্যানার্জি নিজেই বিজেপি মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন। তাই নির্বাচনী প্রচারের ঢক্কানিনাদ চলছে।
শোষণের শিকার
চা-তামাক-বনাঞ্চল ও আম এই চারটি বিশেষ মূল্যবান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই দেশি-বিদেশি শোষণের শিকার। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ চা কোম্পানির মালিকেরা মুনাফার জন্য চা বাগান শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক শোষণ চালাতো। মূলত ওডিশা ও বিহার থেকে সহজ সরল আদিবাসী মানুষদের আড়কাঠির মাধ্যমে সুখের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে আসা হতো। ওইসব রাজ্যের আদিবাসী এলাকাগুলো থেকে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ট্রেনের কামরায় তুলে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেওয়া হতো যাতে কেউ চরম কষ্ট অসহ্য মনে হলেও পালিয়ে যেতে না পারে। কলকাতায় গঙ্গার ঘাটে বসতো 'কুলির' বাজার। শুরু হতো ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীর জীবন। চা বাগানগুলো জনবসতি থেকে অনেক দূরে থাকায় সহজ সরল মানুষগুলো পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পেত না। মুক্তি মিলত মৃত্যুর পর। 
বর্তমানে উত্তরবাংলায় নথিভুক্ত বড় ও মাঝারি ধরনের ৪৪৯টি চা বাগান ছাড়াও প্রায় হাজার তিরিশেক খুবই ছোট আয়তনের জমিতে চা চাষ করা হয়। এইসব চাষিদের নিজস্ব কারখানা নেই। বর্তমানে চা শিল্পে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষ তেত্রিশ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী অন্তত ২৫ লক্ষ মানুষ রুটি-রুজির জন্য চা বাগানের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু তৃণমূলের তোলাবাজির জন্য বহু চা বাগান বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ চা বাগানের কর্মীরা প্রায় না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। বন্ধ চা বাগানে নারী পাচার বর্তমানে চা বাগান শ্রমিকদের একটা বাড়তি সমস্যা। মা-বাবা তাদের নাবালিকা মেয়েকে আড়কাঠিদের হাতে তুলে দিতে একপ্রকার বাধ্য। চাকরি দেবার নাম করে নাবালিকাদের ভিন রাজ্যে পাচার করা হয়। তারপর সেই দুর্ভাগাদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। 
সরকারি হেনস্তায় কোচবিহারের তামাক চাষিরা এখন আর তামাক চাষে আগ্রহী নন। তৃণমূলী হানাদারদের দৌরাত্ম্যে পর্যটকদের দেখানোর জন্য উত্তরবঙ্গের বনসম্পদের শুধু কঙ্কালটুকু অবশিষ্ট আছে। তারমধ্যেও তৃণমূলীরা বেআইনি 'হোম স্টে' খুলে নানারকম ব্যবসা করছে। উত্তরবঙ্গের জঙ্গলও এখন ২৫-৭৫ বখরা হিসাবে বিক্রি হয়ে গেছে। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় হাতি, বাঘ, গন্ডার, বাইসন ইত্যাদি বুনোজন্তু লোকালয়ে চলে এসে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। তৃণমূলী রাজত্বে পশুরাও নিরাপদ নয়। তিস্তানদীও অনেকটাই ব্যবসায়িক কারণে বিক্রি হয়ে গেছে। তৃণমূলী শাসনে রাজ্যের শুধু নদীনালা নয়, পাহাড় পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। তৃণমূলী প্রোমোটারের থাবা পাহাড়ের ওপরেও নেমে এসেছে। ফলে পাহাড়ের পাথরগুলো আলগা হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝেই পাহাড়ে ব্যাপক ধস নামে। মালদার অনেক আমবাগান প্রোমোটারের দখলে চলে গেছে। তাই মালদা আর এখন তার আমের জন্য অতীতের মতো গর্ব করতে পারে না।
নজিরবিহীন বৈচিত্র
রাজ্যের মোট ২৩টি জেলার মধ্যে আটটি জেলার ২৬,২৮২ স্কোয়ার কিলোমিটার নিয়ে গঠিত উত্তরবাংলার জনসংখ্যা ১,৮৭,০২,৬০ জন। জনসংখ্যার ২৭.৩৫ শতাংশ ও ১৫.৭৮ শতাংশ যথাক্রমে তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৯৭৬ সালের আইন অনুসারে এখানে এখন নির্দিষ্ট ভাবে ৩৩টি আদিবাসী সম্প্রদায় বাস করে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা আছে। রাজ্যের ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠী টোটো উপজাতির বাসও আলিপুরদুয়ারের কাছে টোটোপাড়াতেই। আর কোথাও এই সম্প্রদায়কে দেখা যায় না। টোটো সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা মাত্র ১,৬৩২। আয়তনের দিক থেকে উত্তরবঙ্গের আয়তন পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের প্রায় এক চতুর্থাংশ। ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে এই অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে অবশ্যই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবি করতে পারে। সাম্প্রতিক এক তথ্য অনুযায়ী উত্তরবাংলায় ১০১টি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আছে। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চল ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ—এই তিনটি আন্তর্জাতিক সীমানা দিয়ে ঘেরা।
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি হয়েই চীন সীমান্তে যাতায়াত করার পথ। ভারতের অন্য কোনও এলাকা সামরিক দিক থেকে এতো স্পর্শকাতর নয়। আবার এখানেই আছে সেই বহু আলোচিত 'চিকেন নেক'। 'চিকেন নেক' ভারতের মানচিত্রের সবচাইতে দুর্বল জায়গা। নেপাল ও বাংলাদেশের মাঝে মাত্র ৩৫-৪০ কিলোমিটার চওড়া ভারতের ভূখণ্ড। এই অংশের মধ্য দিয়েই বাংলার জলপাইগুড়ি, কালিম্পঙ, দার্জিলিঙ, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার— এই পাঁচটি জেলা সহ ভারতের আটটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হয়। দার্জিলিঙ, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এই পাঁচটি জেলা সহ ভারতের আটটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হয় এই করিডর দিয়েই। এর ওপর ভিত্তি করেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মিসেস কার্কপ্যাট্রিক তাঁর কুখ্যাত 'অপারেশন ব্রহ্মপুত্র' বা 'সেভেন সিস্টার্স প্ল্যান' তৈরি করেন। এই এলাকাতেই-নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় - চারটি নরগোষ্ঠীই দীর্ঘদিন ধরে তাদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই একসঙ্গে বসবাস করছে। গোটা পৃথিবীতেই এই নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মুখ্যমন্ত্রীর কার্নিভাল ও বামপন্থীদের ত্রাণ শিবির
বিধ্বংসী বন্যায় সব হারানো উত্তরবাংলার মানুষ যখন দিশাহারা, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন কার্নিভালে আরও অনেকের সাথে তাঁর নাচ দেখাচ্ছেন। টিভির পর্দায় এই দৃশ্য দেখে অনেকেই লজ্জাবোধ করেছেন। ঠিক সেই সময় বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠন, রেড ভলান্টিয়ার্স, ডাক্তারদের সংগঠন সহ আরও অনেকে শুকনো খাবার, পানীয় জল, শিশুদের জন্য গুঁড়ো দুধ, নতুন জামাকাপড়, মশারি ইত্যাদি সব অতি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যে-কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে কোনোরকম বাছবিচার না করেই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই বামপন্থীদের ঐতিহ্য। স্বাভাবিক কারণেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার অংশীদারদের এসব পছন্দ নয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী মানুষের কথা চিন্তা না করে শুধু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কারণেই ঘোষণা করলেন, ‘ত্রাণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে’। সঙ্গে সঙ্গেই তোলাবাজেরা বামপন্থী ত্রাণ-কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। 
সাম্প্রতিককালে আমেরিকার নির্দেশে গাজাতেও একইরকম ঘটনা ঘটেছে। এই বিপদের সময় উত্তরবাংলার মানুষ অবাক চোখে দেখলো শাসকশ্রেণি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে! বিজেপি হাতে কোনোকিছু না নিয়েই গাড়ি যাত্রা করে ত্রাণের নাটক করল। তৃণমূলীরাও সেই নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী। মানুষের দুর্দশার চাইতে তৃণমূল-বিজেপি’র সাজানো নাটকই বাংলার সংবাদ মাধ্যমে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। মূল স্রোতের সংবাদ মাধ্যমের কথা বিশেষ কিছু না বলাই ভালো। প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম এখন কর্পোরেটদের মালিকানায়। সামনে উত্তরবঙ্গের ভয়ঙ্কর শীতকাল। যাঁদের সবকিছু ভেসে গেছে, তাঁরা কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন?
উত্তরবঙ্গের মানুষের দুর্দশা ও নানা ষড়যন্ত্র
লক্ষ লক্ষ মানুষের সংগ্রাম ও প্রাণের বিনিময়ে ভারতের স্বাধীনতা এলেও বাংলা ভাগের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু শেষপর্যন্ত বিভাজনের রাজনীতির একটা মারাত্মক খেলা খেলেছে। ক্লিমেন্ট এটলির ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, ৩০ জুন, ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। তখনও ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু নৌ-বিদ্রোহের পরবর্তী ঘটনায় বিচলিত হয়ে ওইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ব্রিটিশ সরকার তাদের পরবর্তী ঘটনায় বিচলিত হয়ে ওইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ব্রিটিশ সরকার তাদের মত পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত নেয় যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু নানা রাজনৈতিক জটিলতায় ভারত বিভাজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভারত বিভাজন মেনে নিয়েও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা নিজেদের মধ্যে বসে দেশটা পরিকল্পিতভাবে ভাগ করতে পারলেন না। তাঁরা নির্ভর করলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত আইনজীবী সিরিল র্যাাডক্লিফের ওপর। ভারত সম্বন্ধে প্রায় অনভিজ্ঞ র্যা ডক্লিফ মাত্র ৩৭ দিনের মাথায় দুটো দেশের মধ্যে ৪,০৯৬.৯ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করার দায়িত্ব নিয়ে ভারতে এলেন। কিন্তু তিনি দিল্লিতে বসে টেবিলের ওপর ভারতের ম্যাপ রেখে লাল-নীল পেনসিল দিয়ে দাগ কেটে ৩৩ দিনের মধ্যেই তাঁর দায়িত্ব পালন করে ৪ দিন আগেই দেশে ফিরে গেলেন। সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো উত্তরবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রটাই তার প্রমাণ।
মূলত কলকাতা-নির্ভর উত্তরবঙ্গ থেকে সরাসরি সড়ক বা রেলপথে কলকাতা যাতায়াতের উপায় প্রায় নেই বললেই চলে। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় যেতে গেলে ১৬২ কিলোমিটার রাস্তা বিহার রাজ্যের ওপর দিয়ে যেতে হয়। ভারতের আর কোথাও গেলেও ১৬২ কিলোমিটার রাস্তা বিহার রাজ্যের ওপর দিয়ে যেতে হয়। ভারতের আর কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা আছে বলে জানা নেই। উপযুক্ত মনোযোগের অভাবেই তৈরি হয়েছে তিনবিঘা করিডরের সমস্যা। ভারতের মধ্যে পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ), তারমধ্যে আবার ভারত। একটা পাটখেতের আয়তন নিয়ে এখানে বাংলাদেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা ভারত। পৃথিবীর আর কোথাও এমন অবস্থা আছে বলে জানা নেই। অপরিকল্পিত বাংলা ভাগের জেরেই উত্তরবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দেয়। আসাম, ভুটান, নেপাল বা বাংলাদেশে অস্থিরতা দেখা দিলে উত্তরবঙ্গের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
চাই স্বাস্থ্য, চাই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা
মহাকাল মন্দিরের অভাব উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে কোনও সমস্যাই নয়। ওদের চাই উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। উত্তরবাংলার মানুষকে ঘটিবাটি বিক্রি করেও চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় ভিন রাজ্যে। এমন খুব কম মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যাদের কাউকে না কাউকে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পাটনা যেতে হয়নি। যাতায়াতের অসুবিধা সহ নানা কারণে উত্তরবঙ্গের মানুষ কলকাতার চাইতে চিকিৎসার জন্য ভিন রাজ্যে যাওয়া বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করেন। অথচ বামফ্রন্টের উদ্যোগে ২০০৯ সালে উত্তরবঙ্গের জন্য ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৬০টি শয্যা বিশিষ্ট একটি এইমস খোলার প্রস্তাব পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছিল। বামফ্রন্টের উদ্যোগে রায়গঞ্জের কাছে পানিশালায় জমি জরিপের কাজও শেষ হয়। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই মমতা ব্যানার্জি উত্তরবঙ্গ থেকে এইমস গায়ের জোরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। বিষয়টি উত্তরবঙ্গের মানুষ আজও ভোলেননি।
প্রশাসনের কাছে উত্তরবঙ্গ মানে শুধু দিন-কয়েকের জন্য বেড়ানোর জায়গা। তাই নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত এসেই তারা থেমে যায়। তারপরেও বাংলাদেশ ও আসাম সীমান্তের কাছে যে প্রায় ২০০ কিলিমিটার উত্তরবঙ্গ আছে সেকথা রেল কর্তৃপক্ষও ভুলে যায়। বন্দে ভারতের মতো একটা দ্রুতগামী ট্রেন শুধু এনজেপি পর্যন্ত চলে। কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ারের প্রান্তিক এলাকা থেকে কলকাতা আসতে সময় লাগে প্রায় ১৮ ঘণ্টা। বন্দে ভারতের সঙ্গে একটা সংযোগকারী ট্রেনের ব্যবস্থা করলেই কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বসবাসকারী মানুষের অনেক কষ্টের অবসান হয়। একটামাত্র বিমানবন্দর বাগডোগরা। জরুরি কারণে দ্রুত কলকাতায় যেতে হলে আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার মানুষ বাগডোগরায় না-গিয়ে আসামের রুপ্সি বিমানবন্দর থেকে বিমান ধরেন। বাগডোগরার চাইতে অর্ধেক সময়ে রুপ্সি আসা যায়। এই বিষয়গুলোতে নজর না দিয়ে বিজেপি-তৃণমূল শুধু ভোটের রাজনীতি করছে। ভোট এলেই ওরা গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুরি ইত্যাদি নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিষয়গুলো উসকে দেয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আর্থিক সহায়তায় কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এই বিষয়ে মদত দিয়ে চলছে। তবে তেভাগা সহ শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের অনেক সংগ্রামী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উত্তরবাংলার মানুষ এখন বুঝতে পারছেন মন্দির দিয়ে সমাজের অগ্রগতি হয় না। অগ্রগতির জন্য চাই সুসংবদ্ধ আর্থিক পরিকল্পনা। একমাত্র বামপন্থীরাই এর জন্য লড়াই করে।
 

Comments :0

Login to leave a comment