ডাঃ কৌশিক লাহিড়ী
“As long as the world shall last there will be wrongs, and if no
man objected and if no man rebelled, those wrongs would last
forever.”
– Clarence Darrow (1857-1938)
ইয়োর অনার,
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ, আর জি কর মেডিক্যা্ল কলেজ ও হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে একজন মহিলা ডাক্তারের মৃতদেহ অর্ধনগ্ন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ৩১ বছর বয়সি এই ডাক্তারের দেহে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন ছিল। এই ঘটনা সারা দেশজুড়ে অভূতপূর্ব এবং তীব্র প্রতিবাদের জন্ম দেয়। যেটা শুনলে আমার খুব অস্বস্তি হয় কিছু রোগী মাঝে মাঝেই যেটা জিজ্ঞেস করেন, সেই প্রশ্নটা সেদিন আমার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
-আচ্ছা বাবা, সেই আর জি করের ডাক্তারদিদিটাকে কারা মেরেছিল?
আমি বললাম, -জানি না।
কথার পিঠে উঠে আসা আর একটা সরল প্রশ্ন, -কেন মেরেছিল?
আমি আবার বললাম, এবার একটু অকারণ রূঢ়তা মিশে গেল, গলায়। —বলছি না,জানি না!
মেয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর আমি চশমা মোছার অছিলায় তাকিয়ে থাকলাম অন্যদিকে। আমার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরানো অসহায়তার উল্টোদিকে।
কারা মেরেছিল? কেন মেরেছিল? কারা প্রমাণ লোপাট করেছিল? কেন করেছিল? আসলে এই প্রশ্নগুলো আমাকে প্রায় রোজই কেউ না কেউ করেন, আর আমি একটু একটু করে হেরে যেতে থাকি। একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়তা, একটা ক্রোধ আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি মানে আমরা! মানে চিকিৎসক-অচিকিৎসক মিলিয়ে একটা গোটা সমাজ। যারা সাক্ষী হয়ে আছি একটা নৃশংস নেতিবাদী ইতিহাসের! মাঝে মাঝে মনে হয়, বটেই তো! নো ওয়ান কিলড অভয়া! নো ‘ওয়ান’!
একজন নয়, একাধিক জন! সবাই বোঝেন, পূর্ণবয়স্কা, সুস্থ-সবলা এক নারীকে একা কারো পক্ষে ঐরকম নৃশংসভাবে হত্যা করা সম্ভব নয়। কিছু লোক মিলে মেরেছিল। কিছু লোক সেটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আবার এখনও কিছু লোক আপনার সামনে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে একমাত্র একজনই খুনি। তাকে ফাঁসি দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়।
আমরা এতদিনে জেনে গিয়েছি অভয়াকে যেমন কেউ মারেনি, শিশু তামান্নাকেও না। আফিসা বা হাথরাসের মেয়েটিকেও। ওদের কেউ ধর্ষণ ও হত্যা করেনি। জেসিকা লাল বা আরুষি মারাই যায়নি। খুন তো দূরের কথা! অথবা, টুজি, ব্যাপম, সারদা, নারদ— এসব কিচ্ছু ঘটেনি। নেহাতই গল্প! ললিত মোদী , মেহুল চকসি, বিজয় মালিয়া, নীরব মোদীর নাম তো কেউ কোনোদিন শোনেইনি! আর হ্যাঁ বাবরি মসজিদ কেউ ভাঙেনি! NEET-UG পরীক্ষায় বা SSC তে কোনও দুর্নীতি হয়নি। এমনকি আমাদের রাজ্যের মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্বাচনে ২০২২-একোনও গন্ডগোল হয়নি। সমস্ত কিছু ছিল একেবারে স্বচ্ছ, সুন্দর, বিধিপূর্বক।
মুখ ঢেকে যাক ফেসবুকে! যেহেতু শঙ্খ ঘোষের অপমান, অম্বিকেশ মহাপাত্রের লাঞ্ছনা অথবা টেলিফোনে বোলপুরের পুলিশকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা শুনেও আমি চুপ করে ছিলাম। পানসারে, দাভোলকার, কালবুর্গি,গৌরী লঙ্কেশ, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাসের হত্যাকাণ্ড, আসিফ মহিউদ্দীনের ছুরিকাহত হওয়ার ভয়ঙ্কর খবরগুলি আমি শুনেও শুনতেও পাইনি। গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে এই রাজ্যে পুরুলিয়ায়, পাঁশকুড়ায়, ডেবরায়, শিলিগুড়িতে , ভাঙ্গরে, আউশগ্রামে, গোপীবল্লভপুরে, মালদায়, মথুরাপুরে, বোলপুরে, বর্ধমানে, ইসলামপুরে, মুর্শিদাবাদে, রায়গঞ্জে, ভগবানগোলায়, ডায়মন্ডহারবারে, দার্জিলিঙে, হেমতাবাদে এবং আরও বহু-বহু নাম শোনা না শোনা জায়গায় অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, আহত, বিধ্বস্ত হয়েছেন অন্তত শছয়েক চিকিৎসক! টিভিতে যখন এই চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনাগুলি দেখায় আমি টিভি থেকে চোখ সরিয়ে রিমোটের ছোঁয়ায় ওটিটির নিরাপদ মঞ্চে পৌঁছে যেতাম তাই সত্যিকারের পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ঘটে যাওয়া সত্যিকারের ঘটনা আমাকে ভারী অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। আমাকে শুধু নয়, আমাদের!
আর একটা সুবিধা কী জানেন স্যার, একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি মানুষকে অভ্যস্ত করে দেয়। তখন সে কোনও প্রতিক্রিয়া অনুভব করে না, তা সে অন্যায়ের প্রতিই হোক, বা মৃত্যুর প্রতি! রেডিওতে, টিভিতে, খবরের কাগজে, মৃত্যুমিছিল সংবাদের নিত্যনৈমিত্তিকতা বা চোখের চামড়াহীন জোচ্চুরি মানুষকে অভ্যস্ত করে তোলে। অন্ধত্বে, বধিরত্বে, সংবেদনহীনতায়। অসাড়, অ্যা নাস্থেটাইজড একটা গোটা যুগ, গোটা প্রজন্ম।
তাই, আসুন এসব অভয়া-টভয়া ভুলে যান। আর দু’দিন পরই একটা নতুন তাজা খবর আসবে, আমরাও লাফিয়ে উঠে, তাজা উত্তেজনায় ঝাঁপাবো! কিন্তু এমন তো আগে প্রায় ঘটেনি কখনো! আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, করাল করোনাকালে সব ধর্মের উপাসনাগৃহেই তালা ঝুলছিল! খোলা ছিল কেবল হাসপাতাল! এই বিপদের দিনে পাশে পেয়েছিলাম কোনও ধর্মগুরুকে নয়, রক্ষাকর্তা হিসাবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন আছেন কেবল সাদা পোশাক পরা ওই চিকিৎসক আর চিকিৎসকর্মীদেরই! অতিমারী থেকে বাঁচানোর ভ্যাকসিন এসেছিল বিজ্ঞানের গবেষণাগার থেকে, কোনও ধর্মস্থল থেকে নয়! পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে এমনকি বিশ্বযুদ্ধের সময়েও হাসপাতাল ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা। সম্মানের জায়গা। অভয়ারণ্যের মতো সেখানে গুলি চালানো বারণ ছিল। আকাশ থেকে ভুল করেও যাতে বোমা না পড়ে যায় সেই জন্য হাসপাতালের ছাতে আঁকা থাকতো রেডক্রস বা বৃত্তের মধ্যে একটি ক্রস। সেখানে, চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষ, রোগীরাও থাকেন সুরক্ষিত, নিশ্চিন্ত। শেষ মহাযুদ্ধ কাটিয়ে পৃথিবী এখন একুশ শতকের তৃতীয় দশকে। যে দশক সাক্ষী থাকলো, পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর গুলির একটিতে, যেখানে নবজাগরণ হয়েছিল, যেটি আবার দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী, সেখানে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মেধাবী, পরিশ্রমী একটি তরুণী চিকিৎসককে, ছত্রিশ ঘণ্টা একনাগাড়ে ডিউটি দেবার শেষ পর্যায়ে হতক্লান্ত অবস্থায়, অত্যাচার করে খুন করে কয়েকটি নরপিশাচ। যূথবদ্ধ শেয়াল, বুনো কুকুর, হায়না, পিরানহার দলও লজ্জা পাবে, সেই হত্যাকাণ্ডের নারকীয় বীভৎসায়! স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পেরিয়ে একজন চিকিৎসককে তাঁর কর্মস্থলে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো এই সমাজ। একে কী আদৌ সভ্যতা বলা চলে ইয়োর অনার?
অনার মানে সম্মান! আমাদের, মানে এদেশের সাধারণ মানুষের কোনও অনার নেই, ইয়োর অনার?
গতবছর ২ অক্টোবর, দেবীপক্ষের সূচনায় আরজি কর হাসপাতালের বুকে প্রতিষ্ঠা হলো অভয়া মূর্তির। সে মূর্তি বীভৎস। চোখ বিস্ফারিত। এমন বীভৎস মুখ না করে সুন্দর মুখ দেওয়া যেত যাঁরা বলছেন, তাঁদের বলি, মাতঙ্গিনী হাজরার সুন্দর সিঁথি কাটা চুল, ডাগর চোখ, হাসিমুখের কোনও ছবি দেখেছেন কখনো? ওই হাহাকার ভরা, বলিরেখা লাঞ্ছিত, যন্ত্রণাদীর্ণ মুখ আর শক্ত হাতে জাতীয় পতাকা ধরে রাখা অবয়বটাই মাতঙ্গিনী। শিল্প কথাটা যে একটু বিস্তৃত! এডুয়ার্ড মানচের দ্য স্ক্রিম ছবি, পিকাসোর বিকৃত মুখের ঘোড়া, রঁদ্যার দ্য ক্রাই বা রামকিঙ্করের ন্যুব্জদেহ রবীন্দ্রনাথ এগুলো আপাতদৃষ্টিতে দৃষ্টিসুখকর নয়, সেগুলোও কিন্তু শিল্প! অথবা অশনিসংকেত বা আকালের সন্ধানে! অবরুদ্ধ প্যারিসে পিকাসোর অ্যাপার্টমেন্টে এক ফাসিস্ত গেস্টাপো অফিসার ঢুকে গোয়ের্নিকা ছবিটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলে, ডিড ইউ ডু দ্যাট? পিকাসো উত্তর দেন, নো, ইউ ডিড!
শিল্পী শুধু রূপ দিয়েছেন এই বিমূর্ত হাহাকারের। কিন্তু এর আসল স্রষ্টা তো তার হত্যাকারী সমাজ! খুনি তো একজন নয়! খুনি তো আমাদের সামগ্রিক বিবেকহীন, হৃদয়হীন, শিরদাঁড়াহীন, চক্ষুলজ্জাহীন নীরবতার যোগফল! আমাদের সকলের হাতেই রক্ত লেগে আছে! তাই আমাদের কেউ কেউ এই মূর্তি সরাতে চাইছে! তাদের অস্বস্তি হচ্ছে! এ মুখ শুধু অভয়া বা তিলোত্তমার তো নয়! এ মুখ ভয়ের কুসংস্কৃতিতে নষ্ট-ভ্রষ্ট-ধর্ষিত এই সময়ের প্রতীক! এ মুখ আমাদের নিশ্চিন্ত নিরাপদ নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানো দুঃস্বপ্ন হয়ে জেগে থাকবে! যাঁরা অভয়ার নাম বাদ দিতে চান, তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করছেন। হলোকাস্ট মিউজিয়াম থেকে হলোকাস্ট শব্দটা সরিয়ে দেওয়াটা ঐতিহাসিক ভুল শুধু নয়, অপরাধও! সে মুখ শুধু অভয়ার নয়, নির্ভয়ার নয়, তিলোত্তমার নয়! সে মুখ যমুনাবতীরও! দ্রোহপক্ষে সে মুখ দুর্গার!
কিছু প্রশ্ন- কারা খুন করেছে? কেন খুন করেছে? কারা প্রমাণ লোপ করেছে? কারা তাদের সহায়তা করেছে? বা চেষ্টা করেছে প্রমাণ লোপের? কেন? সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট এখনো নেই কেন? কেন বিচারপ্রক্রিয়ায় এই শ্লথগতি? কেন সিসিটিভি ফুটেজের পুরোটা প্রকাশিত হয়নি আজও? কেন সব হারানো বাবা-মায়ের পাশে শাসক নেই?
এই আন্দোলন ঐতিহাসিক। সিপাহী-বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ বা বিয়াল্লিশ, খাদ্য-আন্দোলন, নকশাল অন্দোলনের ঢেউও এইভাবে মথিত করেনি বঙ্গসমাজকে! ক্ষুদিরামের ফাঁসি, বিনয়-বাদল-দীনেশের হত্যা, মাস্টারদা, নেতাজীর হারিয়ে যাওয়া কোনও ঘটনাতেই এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভের সুনামি আছড়ে পড়েনি! “এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ”, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, জল উপেক্ষা করে, মাইলের পর মাইল রাস্তায় অভূতপূর্ব মানবশৃঙ্খল, পথ-গ্রাফিত্তি এইভাবে কোনোদিন কেউ দেখেনি। শুধু শহর নয়, রাজ্য ছাড়িয়ে, দেশের অন্য শহর, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল এই স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ আন্দোলনের আগুন। তবুও বিচার অধরা! আর কবে, ইয়োর অনার?
সেই কবিতাটা মনে পড়ে?
“জল বাড়ছে, জল বাড়ছে
সমস্ত ঘুম ভেঙে দেবে এবার
জল গড়িয়ে এসেছে কলকাতার ময়দানে
চতুর্দিকে থেকে শহরকে ঘিরে দৌড়ে আসছে ওরা
লাল, নীল, সবুজ বিভিন্ন রঙের
পতাকা ওড়ানো অফিসে দুমদাম করে
ধাক্কা দিচ্ছে জল
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে…”
এবার অন্তত রুখে দাঁড়ান, শিরদাঁড়া সোজা রেখে, খুনি, নির্লজ্জ, অপরাধীদের শাস্তি দিন। না হলে বিদ্রোহের এই উপচে আসা জল মাথার ওপর দিয়ে বইতে শুরু করে ভিসুভিয়াসের লাভাস্রোতে পরিণত হতে কিন্তু সময় লাগবে না!
Comments :0