Suiri

‘‘ইকাউন্ট খুললে কে?’’ ক্ষিপ্ত প্রশ্ন সুন্দরি বাসকির

রাজ্য

রণদীপ মিত্র : সিউড়ি
খেতমজুর মমতা মির্ধা জানেনও না তাঁর নামে সমবায় ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে! শুধু তাই নয়, তাতে লেনদেন হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার! 
শুধু মমতা মির্ধার অ্যাকাউন্টই নয়, ২০১৬ সালের পর খোলা হয়েছিলো এমন ১৭৭ টি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট। জানা গিয়েছে, এসব ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকেই হয়েছে সরকারি প্রকল্পে প্রাপ্য টাকার লেনদেন!
বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সেই ১৭৭ টি অ্যাকাউন্টই এখন সিবিআই’র র্যাবডারে। অ্যাকাউন্টগুলি কাদের? সিউড়ি সমবায় ব্যাঙ্কে সিবিআই হানার পর প্রকাশ্যে আসা অ্যাকাউন্টগুলির হদিশ করতে গিয়ে তাজ্জব বনেছেন তদন্তকারীরাই। 
এসব ভুয়ো অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের অন্যতম মমতা মির্ধা। অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করে সংসার চলে তাঁর। বাড়ি সিউড়ি ২নং ব্লকের হরিপুরে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই যেন আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। সাফ জানালেন, ‘‘আমার সিউড়িতে কোন অ্যাকাউন্ট নেই। পুরন্দরপুরে অন্য ব্যাঙ্কে একটিই অ্যাকাউন্ট আছে। আমার নামে কে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, জানি না।’’ প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনি কি কোথাও আধার কার্ড, ছবি দিয়েছিলেন? উত্তরে বলেছেন, ‘‘অনেক জায়গায় দিয়েছি। লক্ষ্মীর ভান্ডার’র জন্য দিয়েছি, পায়খানা বানানোর জন্য দিয়েছি। সেগুলো নিয়ে কে কি করেছে কী করে জানবো?’’ 
তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে গোরু পাচার মামলার তদন্তে বৃহস্পতিবার সিউড়ির সমবায় ব্যাঙ্কে আচমকা সিবিআই হানায় বেকায়দায় পড়েছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও। ফলে নিজেদের হয়ে সাফাই দিতে শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন ব্যাঙ্ককর্তারা। সেখানে বেশিরভাগ বক্তব্যই রেখেছেন ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। তিনি সিউড়ি ২নং ব্লকের তৃণমূল সভাপতি, অনুব্রতর একান্ত ঘনিষ্ঠ জেলা নেতা। দাবি করলেন, ‘‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কের নামে কালি ছেটানো হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এই ব্যাঙ্কে কোনরকম দুর্নীতি হয়নি।’’ অনুব্রতর গোরু পাচারের কালো টাকা সাদা করার জন্যই এই সমবায় ব্যাঙ্ককে ব্যবহার করা হয়েছে? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বরং অনুব্রতর হয়ে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা চালান এই তৃণমূল নেতা। তবে পাশে বসে থাকা ব্যাঙ্কের বর্তমান চেয়ারম্যান অবশ্য কোন কথা বলার সুযোগ পাননি এদিন। কথা বলেছেন ব্যাঙ্কের সিইও বেনজির হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘‘সিবিআই’কে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছি আমরা। যে অ্যাকাউন্টগুলির কথা বলা হচ্ছে সেগুলি সবই কৃষক অ্যাকাউন্ট। সেগুলিতে শুধু সরকারি প্রকল্পের টাকাই ঢুকেছে। কোনরকম নগদ লেনদেন হয় নি। ফলে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা লেনদেনের যে কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়।’’ 
ব্যাঙ্কের এই দাবির পরেই রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। কারণ, ১৭৭টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে রয়েছে সুন্দরি বাসকি নামে এক মহিলার অ্যাকাউন্ট। তাঁরও বাড়ি সিউড়ি ২নং ব্লকের হরিপুরে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কথা শুনে রীতিমতো তেড়েফুঁড়ে উঠেছেন এই গরিব আদিবাসী মহিলা। তাঁর ভাষায়, ‘‘কে আমার ইকাউন্ট খুললে তার কাছে আমায় লিয়ে চল। আমি জবাব লিব। আমি কুনোদিন সিউড়ির ব্যাঙ্কেই যায় নাই। সামান্য জমি আমার। যা ধান হয় তা খেতেই চলে যায়।’’ 
চালকলের মাধ্যমেই যে অনুব্রত মন্ডলের গোরু পাচারের ‘প্রোটেকশন মানি’ বাবদ বিপুল টাকা পার্কিং হয়েছিল তা আগেই খোলসা হয়েছে সিবিআই তদন্তে। এবার বিপুল সংখ্যায় ভুয়ো কৃষক অ্যাকাউন্টের হদিশ যোগসূত্র গড়েছে সেই চালকলের সঙ্গেই। কারণ চালকল কৃষকদের কাছে ধান কেনে। কৃষকদের অ্যাকাউন্টে ধানের দাম দেওয়া হয়। সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে চালকলগুলি সরবরাহ করে সরকারের গুদামে। 
বীরভূম জেলার একটি চালকলের প্রবীণ মালিক জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে বীরভূমে সরকারিভাবে ধান কেনাবেচার সিংহভাগই হয়  অনুব্রতর নামে-বেনামে থাকা চালকলগুলি থেকেই। সেই কারবারে কৃষকদের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট বানিয়ে ধান কেনাবেচা করে বাড়ানো হয় মুনাফার অঙ্ক। এতে সরকারের প্রতিনিধি, ব্যাঙ্ককর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বিশ হাজার হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’ 
এই অভিযোগ যে অসত্য নয়, তার প্রমাণ সুন্দরী বাসকি, মমতা মির্ধা, ভগীরথ ঘোষ, কৃষ্ণা মুর্মু সহ বহু গরিব মানুষ। তাঁদের নামে কৃষক অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে, তাতে ধান কেনার সরকারি সহায়ক মূল্য ঢুকেছে-বেরিয়েছে, অথচ জানেন না তাঁরাই! সিবিআই সূত্রে খবর, অ্যাকাউন্টগুলি খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি গঠন করেছে তারা। পাশাপাশি এদিন সিউড়ি সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে নথি সহ হাজিরাও দিতে হয়েছে নিজাম প্যালেসে।

 

Comments :0

Login to leave a comment