১৯৭৯ সালে আমেরিকার থ্রি মাইল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর ১৯৮৬ সালে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে ইউক্রেন) চেরনোবিল পরমাণু চুল্লিতে বিস্ফোরণ এবং ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমায় পরমাণু চুল্লিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর থেকে আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া সহ গোটা বিশ্বের পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রসার পুরোপুরি থমকে গিয়েছিল। অন্য যে কোনও ধরনের দুর্ঘটনা থেকে পরমাণু দুর্ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিপদ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। যা বছরের পর বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকৃতির অনিবার্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই পরমাণু চুল্লির দুর্ঘটনা ছোট আকারে হলেও তার পরিণাম অতি ভয়ঙ্কর ও সুদীর্ঘ মেয়াদি।
এমন ভীতি ও আতঙ্ক থেকে গত ৪০ বছরে নতুন করে আমেরিকায় কোনও পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়নি। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর গোটা ইউরোপে থমকে গেছে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ। আর ১৪ বছর আগের ফুকুসিমা গোটা বিশ্বজুড়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থবিরতা ডেকে আনে। দূষণমুক্ত বিদ্যুতের অফুরন্ত উৎস পরমাণু হলেও তার বিপদের ভয়াবহতার কারণে কোনও দেশই নতুন করে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর সাহস পায়নি। মানুষের তরফ থেকে প্রবল বিরোধিতা সরকারকে বাধ্য করে পরমাণু ছেড়ে অন্য বিকল্পে জোর দিতে। সেই সূত্রেই গত দেড়-দুই দশকে জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতে জোর দেয় বিভিন্ন দেশ। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। ইদানীং ভারতও সৌর বিদ্যুতে গুরুত্ব দিয়েছে।
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ কমে যাওয়ায় সমস্যায় পড়ে মার্কিন পরমাণু চুল্লি উৎপাদকরা। তাদের চাপে মার্কিন সরকার বিভিন্ন দেশে পরমাণু চুল্লি বিক্রির ছক কষা শুরু করে। ইউপিএ আমলে ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তির আড়ালে ছিল এই ছক। বামপন্থীদের চুড়ান্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও এই চুক্তি করে তৎকালীন সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বামপন্থী সহ বিরোধীদের প্রবল চাপে সরকার বাধ্য হয় পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন করতে যেখানে চুল্লি বিক্রেতা বিদেশি সংস্থাকে দুর্ঘটনার জন্য সব ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। প্রসঙ্গত আমেরিকা নিজের দেশে নতুন পরমাণু চুল্লি না বসালেও ভারতকে রাজি করায় পরমাণু বিদ্যুৎ প্রসারে। বাস্তবে এই দায়বদ্ধতা আইনের কারণেই আমেরিকার কোনও সংস্থা ভারতে কোনও চুল্লি বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তারা মুনাফা করবে কিন্তু কোনও দায় নেবে না।
মোদী সরকার নতুন বিল এনে সেই দায়বদ্ধতা আইন তুলে দেবার এবং পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকানার রাস্তা খুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। দুর্ঘটনা যত বড় বা ক্ষতি যত বেশিই হোক না কেন ক্ষতিপূরণের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৩৯১০ কোটি টাকায়। পরমাণু দুর্ঘটনায় সাধারণভাবে ক্ষতির পরিমাণ এর অন্তত ৩০ গুণ বেশি হয়। দেশি-বিদেশিরা যাতে দায় এড়িয়ে বেশি মুনাফা করতে পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। বাড়তি ক্ষতিপূরণে দায় নেবে সরকার। অর্থাৎ সরকার ক্ষতির দায় নেবে, বেসরকারি পুঁজি নিশ্চিন্তে মুনাফা লুটবে। আর মোদী জমানায় বেসরকারিকরণ মানেই আদানি-আম্বানিদের মালিকানা। সৌর বিদ্যুৎ ক্ষেত্র যেমন তারা কবজা করতে চাইছে তেমনি পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্র দখল করতে চাইছে। একদিকে আদানি-আম্বানি অন্যদিকে মার্কিন সংস্থার মুনাফার স্বার্থে মোদী সরকার পরমাণু বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে দেশের মানুষকে।
Nuke Energy
লক্ষ্য সেই বেসরকারি মুনাফা
×
Comments :0