Awas Yojana scam

বঞ্চিতদের ক্ষোভ উগরে পড়ল দেগঙ্গা, বাদুড়িয়ার বিডিও দপ্তরে

রাজ্য

লব মুখার্জি ও প্রবীর দাস: বসিরহাট ও দেগঙ্গা 

বিডিও অফিসে ঢোকার প্রধান দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে পুলিশ দিয়েও বিক্ষোভ ঠেকানো গেল না। বিডিও দপ্তরের তালা বন্ধ গেটের সামনেই আবাস যোজনার হকের পাওনা থেকে বঞ্চিতদের ক্ষোভ উগরে পড়ল। সংখ্যায় এরা দেগঙ্গা ব্লকের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের গরিব পরিবার। মঙ্গলবার দেগঙ্গা বিডিও দপ্তরে বিক্ষোভ, অবস্থান ও স্মারকলিপি জমা দেওয়ার কর্মসূচিতে দেখা গেল এমনই দৃশ্য। অন্যদিকে, আবাস যোজনার ঘরের কথা বলতে গিয়ে প্রশাসনিক আধিকারিক ও পুলিশের তাড়া খেলেন বাদুড়িয়া কুলিয়া এলাকার গ্রামবাসীরা। সেখানে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেললেন তাঁরা। হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা সন্ধ্যা মণ্ডল, লব মণ্ডল, শিবানী, কালিদাসী, বিশাখা, মালতিরা একযোগে হুঁশিয়ারি দিলেন, ‘ঘর আমাদের হকের দাবি। ঘর আদায় করে তবেই ছাড়ব।’
আবাস যোজনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় গ্রামবাসীদের ক্ষোভ তীব্র আকার নিল এদিন। বিডিও দপ্তরের ভিতরের প্রাঙ্গণে ঢুকে তুমুল বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। ক্ষোভ আছড়ে পড়ল টাকি রোডেও। অবরোধ হল সড়ক পথ। এই স্মারকলিপির সঙ্গে ছবি সহ প্রায় দুই হাজার বঞ্চিত গরিব পরিবার ঘর পাওয়ার আবেদনপত্র জমা দেয়। অভিযোগপত্রে দেখা যাচ্ছে অবৈধভাবে যাঁর নামে ঘর দেওয়া হয়েছে তিনি অন্য একজন গরিব মানুষের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে জমা দিয়েছেন। অথচ যাঁর ভাঙা ঘর তাঁর নাম তালিকাতে নেই। 
বেঁড়াচাপা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের যাদবপুর বুথ থেকে অবস্থানে আসা গ্রামবাসী জাকির মোল্লার কথায়, ‘‘কেবলমাত্র ঘর পাওয়ার আবেদনপত্র নেওয়ার জন্যেই ৫০০ টাকা করে নিয়ে ঘর প্রকল্পের প্রতারণা শুরু করেছে তৃণমূলীরা।’’ অবস্থানে আসা গ্রামবাসী মহম্মদ আনারুল ইসলাম কলসুর পঞ্চায়েতের দক্ষিণ কলসুরের তরফদার পাড়ার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য আবদুল সামাদ মণ্ডলের নাম ধরে সোচ্চারে বলতে থাকেন, ‘‘এই তৃণমূল সদস্য তাঁর দুই স্ত্রীর নামে এবং ছেলের নামে মোট ৩টি ঘরের নাম তুলেছেন।’’ 
তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিপিআই(এম) নেতা সোমনাথ ভট্টাচার্য। বিডিও দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেন, ‘‘বিডিও’র দায়বদ্ধতা রয়েছে। ধনী পরিবারগুলির নাম বাতিল করে প্রকৃত গরিব পরিবারের আবেদন মঞ্জুর করতে হবে। প্রাপকদের নামের তালিকা প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দিতে হবে। অন্যথা হলে এই দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম চলবে।’’ পার্টি নেতা আহমেদ আলি খান বলেন, ‘‘আবাস প্লাস যোজনাতে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবাংলার ভাগে পড়েছে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ঘর। তৃণমূল সরকারের কেলেঙ্কারি স্বজনপোষণ, দুর্নীতির ফলে ইতিমধ্যেই ৫ লাখ গরিব মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর জন্যে দায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।’’ পার্টিনেতা ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, ‘‘হক আদায়ের লড়াইতে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না।’’  অন্যান্যদের মধ্যে প্রতিনিধিদলে ছিলেন দেবাশিস মৈত্র, নারায়ণ চক্রবর্তী, লিলু মুস্তারি খানম প্রমুখ। অবস্থান বিক্ষোভের সমাবেশ  পরিচালনা করেন সিপিআই(এম) নেত্রী পাপড়ি দত্ত। বক্তব্য রাখেন নারায়ণ চক্রবর্তী, তারকেশ্বর চক্রবর্তী, আসরাফুল আহমেদ প্রমুখ।  
ওদিকে এদিন বাদুড়িয়া মিলনী গ্রাম পঞ্চায়েতে তখন আর এক দৃশ্য। ইটভাটায় কাজে না গিয়ে ৮-১০ কিমি পথ ঠেঙিয়ে কেউ বিডিও অফিসে এসেছেন। আবার কেউ চাষের কাজ ফেলে অথবা জনমজুরি ছেড়ে ৫-৬ কিমি পথ সাইকেল চালিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নাম তুলতে। যাঁদের অধিকাংশের প্লাস্টিকে ছাওয়া ঘেরা ঘরে বাস। অথচ ঘরের তালিকায় নাম ওঠেনি। নাম উঠেছে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ সদস্যদের পরিবারেরও। বিডিও অফিস চত্বরে বাঁধানো গাছের নিচে রাখা ড্রপবক্সটি তালা-চাবিহীন উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাতে কেউ ঘরের জন্য আবেদনপত্র ফেলছেন আবার কেউ ফেলছেন না। যাঁরা ফেলছেন না তাঁদের বক্তব্য ফেলে কী হবে? ও তো ঠোঙা হয়ে যাবে। 
মঙ্গলবার দুপুরে নয়াবস্তিয়া মিলনী গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬৭ নং বুথের প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ ঘরের জন্য বিডিও অফিসে এসেছিলেন। বিডিও পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রীতা ভট্টাচার্য, শিল্পা ব্যানার্জি, সুমিত্রা ভট্টাচার্যদের। শেষে কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা সারা ভারত কৃষকসভার নেতা তসলিম আরিফ সহ অন্যান্যরা বিডিও সুপর্ণা বিশ্বাসের সাথে দেখা করেন এবং কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য রমা মণ্ডল ও ১৬৭ নম্বর বুথের পঞ্চায়েত সদস্য দিলীপ মণ্ডলের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ জানান। 
বিধ্বংসী আমফানের তাণ্ডবে কুলিয়া গ্রামের লালবানু সরদারের ঘর ভেঙে পড়লে পরিবার নিয়ে ইটভাটায় আশ্রয় নেন। ঠিক তেমনই গাছের ডাল ভেঙে ঘর চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব ফেলো মণ্ডল। কেউই ঘরের তালিকায় নাম তুলতে পারেননি। যেমন পারেননি নারায়ণপুর শাখারবাগান এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধা কুন্তী মণ্ডল, যদুরহাটির দারিগোবিন্দপুরের বাসিন্দা শ্রীদাম দাস। ওদিকে বাবা সিপিআই(এম) করেন, সেই অপরাধে রামচন্দ্রপুর উদয় গ্রাম পঞ্চায়েতের আটলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ফতেমা বিবির নাম তালিকায় নেই। তেমনি তালিকায় নাম নেই পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা দীনমজুর প্রমিলা সরকারের। 
এদিকে দিকে বসিরহাট-১ নম্বর ব্লকের গোটরা গ্রাম পঞ্চায়েতের আশা ও আইসিডিএস’র কর্মীরা দ্বারস্থ হলেন বিডিও বিশাখ ভট্টাচার্যের। জমা দিলেন ১২ জন আশা ও আইসিডিএস কর্মীর সই সংবলিত অভিযোগপত্র। তাতে উল্লেখ আছে, আশাকর্মী প্রমীলা গায়েনকে আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তুষার মণ্ডল নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। প্রমীলাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এরপর বাকিদের ওপরেও নেমে আসতে পারে। উপযুক্ত নিরাপত্তা ও এই কাজ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে অভিযোগ পত্রে।

Comments :0

Login to leave a comment