রণদীপ মিত্র
তছনছ হওয়া ঘরটির চেহারা পালটায়নি বিন্দুমাত্র। দেওয়াল জুড়ে নৃশংসতার কালো ক্ষত জ্বলজ্বল করছে এখনও। মাথার ছাউনি উপড়ে বিধ্বস্ততার নির্মম ছবি এখনও বহন করে চলেছে বাড়িটি। সেই রাতের হাড়হিম করা নিষ্ঠুরতায় যা হাল হয়েছিল বাড়িটির, সেই একই চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সে। স্রেফ তালা পড়েছে সদর দরজায়। তদন্তের স্বার্থে। বেঁচে যাওয়া বাড়ির লোকেরা জোর গলায় বলছেন, ‘‘মেঝেতে ঝাঁট দিলে এখনও জড়ো করা যাবে অসংখ্য হাড়ের কুচি!’’
রূপালি বিবির সেই বাড়ি। ঠিকানা বগটুই। বছর খানেক আগে যে বাড়ি সাক্ষী হয়েছিল সাম্প্রতিককালে দেশের নির্মমতম হত্যালীলার। এক বছর পড়ে কি অবস্থায় আছে সেই বাড়ি? বাড়ির বর্তমান মালিক মা, বোন, ভাতিজা, চাচিকে হারানো যুবক কিরন শেখের কথায়, ‘‘দমকল-পুলিশ শুধু কঙ্কাল তুলে নিয়ে গিয়েছিল। হাড়গোড় বহু পড়েছিল ঘরেই। আমরা বস্তাবন্দি করে যতটা পেরেছি কবর দিয়েছি। এখনও হাড়ের কুচি পড়ে রয়েছে মেঝেতে। ওই ঘরে আর ঢুকি না। ঢুকলেই মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা।’’ দশ-দশজন স্বজনকে হারানোর যন্ত্রনায় আজও থেকে থেকেই কুঁকড়ে ওঠেন জাহানারা, আতিহারা, রূপালি বিবিদেরর কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বংশধরেরা। ভিজে চোখে যাদের মুখে শোনা যায় বক্রোক্তি, ‘‘আমাদের কেউ তো মারা যায় নি!’’ এমন মন্তব্যের ইঙ্গিত খোলসা হয় খানিকটা পড়ে। এক বছর আগে কেরোসিন, পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে, কুপিয়ে জ্যান্ত মেরে ফেলা হয়েছিল একের পর এক শিশু মহিলাকে। এক বছর অতিক্রম হতে চলল বগটুইয়ের সেই ঘটনার। এখনও পর্যন্ত একজনেরও ডেথ সার্টিফিকেট মেলেনি। মৃতাদের স্বামী,  ছেলে, ভাইপোরা এ দোর ও দোর ঘুরে ঘুরে আজ ক্লান্ত। পঞ্চায়েতে গেলে সে দেখায় ব্লক। ব্লক দেখায় মহকুমা। মহকুমা দেখায় উপরতলা নির্দেশের জুজু। দশ দশটি তাজা গ্রাণকে কালো মন্ডে পরিণত হয়ে, তার কঙ্কাল চেঁছে বের করার দৃশ্য দেখা পরিবারের জীবন্ত সদস্যরা বিতৃষ্ণায় আজ বলতে বাধ্য হন, ‘তাদের কেউ তো মরেনি!’ যুবক কিরন শেখের যেমন এ নিয়ে ক্ষোভও খুব। বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম তো মাঝে মাঝেই আসে। জিজ্ঞাসা করে কেমন আছেন ? এখন বলি, আমাদের কেউ মরেছে নাকি!’’ স্বজন হারানোর যন্ত্রণা কি নিশ্চিতভাবেই বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই স্বজনদের মৃত্যু নিশ্চিত করার নথি না মেলার বিড়ম্বনা যে ঢের গুণ বেশি। তাদের পরিবারের একাধিক সদস্য যে আর বেঁচে নেই তার সবুদ কি আছে ? ফলাফল, বগটুইয়ের ঈদগাহের পাশের নৃশংস হামলার দ্বিতীয় ঠিকানা আতিহারা বিবির সেই বাড়ি আজও একইরম বিপন্নতার সাক্ষী বহন করে চলেছে। ন্যূনতম সংস্কারে হাত পড়েনি। কেন ? ঘটনার চল্লিশ দিন পর মৃত্যু হয়েছিল আতিহারার। তারমাঝে নৃশংসতার ভয়াবহতা আড়ালে মরিয়া সরকার তড়িঘড়ি দিয়েছিল বাড়ি সংস্কারের ক্ষতিপূরণ। টাকা ঢুকেছিল আতিহারার অ্যাকাউন্টে। তারপর চোখ বুঝেছিলেন এই প্রৌঢ়া। কিন্তু সেই টাকা তুলতে গেলেই তো লাগবে ডেথ সার্টিফিকেট। তবেই তো উত্তরাধিকারিরা পাবেন সেই টাকা তোলার অধিকার। মেলেনি আজও। ফুটফুটে মর্জিনার ঘটনার মাস কয়েক আগেই বিয়ে হয়েছিল নানুরে। স্বামীকে নিয়ে এসেছিলে বাপেরবাড়ি এসেছিলেন জাহানার-বাণিরুলের মেয়েটিকে। স্বামী সহ নিয়ে নৃশংসতার বলি হয়েছেন  তিনিও। বিমার টাকা আটকে আছে একই কারণে। তাদের যে মৃত্যু হয়েছে তার নথি কই!
গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প চব্বিশ ঘণ্টার জন্য মোতায়েন এখনও। কোনও ঢিলেমি নেই তাতে। কিন্তু এই সক্রিয়তার ন্যূনতম যদি ২০২২ সালের ২১ মার্চ রাত্রে দেখাতো পুলিশ, তাহলে গ্রামকে দেশের কাছে এমনভাবে কলঙ্কিত হতে হতো না। গ্রামের মানুষের মুখে এ কথা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তবে গাঁয়ের পরিবর্তনও হয়েছে। আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় খুনখারাপির– চাহিদা হয়ে উঠেছে গ্রামের। জেদ নিয়েছে গ্রাম। ঠকে ঠকে গ্রাম শিখেছে লুটের বখড়ার লড়াই দেখে চুপ থাকা মানে তাতে মদত দেওয়া। তাই গত দশ বছরে ২৩ খুনের তকমা বহন করা বগটুই আজ হয়ে উঠেছে প্রত্যয়ী জনপদ। নমুনা গ্রামের দম্পতি মারফত শেখ-গুলশেনারা বিবি। স্বামী টোটো চালান। স্ত্রী ছোট্ট পান বিড়ির গুমটি করে রোজগারে সহায়তা করেন। তাদের কথায়, ‘‘দালান ঘরে থেকে দিনরাত খুন জখম দেখার চেয়ে ঝুপড়িতে শান্তিতে থাকা অনেক ভালো।’’ গুলশেনারার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গ্রামেরই কসির শেখ জানালেন, ‘‘কত চেষ্টা করেছি মারামারি, হানাহানি বন্ধের। কিন্তু করতে দেয়নি। তা করতে গিয়ে এখনও মারের চোটে হাতের হাড় ভেঙে দেওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই ঘুরছি।’’  দীর্ঘ দশকের অভিজ্ঞতায় গ্রাম বুঝেছে গাঁয়ের এই অবনমনের মূলে রয়েছে শিক্ষার অভাব। তাই তো গ্রামে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনকে বগটুইয়ের লজ্জা বলেই মনে করেন বি-টেক পাশ করা ছেলেটা। যার আক্ষেপ, ‘‘গাঁয়ের ছেলে বড় হলে তাদের কাছে শিক্ষার আলো নয়, পৌছে দেওয়া হয় বোমা-বন্দুক। তাই তো গাঁয়ে পা পড়ে সিবিআই’র। রাখতে হয় পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্প। লজ্জার।’’
স্থানীয় তৃণমূলের উপ প্রধান ভাদু শেখ খুন ও তার বদলায় হওয়া গণহত্যা স্তম্ভিত করেছিল দেশকে। তদন্তভার গিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। ঘটনায় প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে যুক্তদের গ্রেপ্তারের পালা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তদন্তকারীরা। সেই তদন্তের রিপোর্টে সিবিআই উল্লেখ করেছে, মূলত বালি, পাথর, কয়লার থেকে আদায় হওয়া তোলার বাঁটোয়ারা নিয়েই বিবাদের পরিণতিতে হয়েছে বগটুই কাণ্ড। কিন্তু মানুষের প্রশ্ন, এই তোলাবাজি, এই লুট, তার বাঁটোয়ারা, বখরার ভাগ দরজায় দরজায় পৌঁছে দেওয়া মসৃণভাবে হয়েছে কাদের মদতে ? রামপুরহাট ও তার উপকণ্ঠে থাকা বগটুইয়ে কান পাতলেই মানুষ এক নিঃশ্বাসে বলে দেবেন সেই নামগুলি। তদন্ত রিপোর্টে কারন উল্লেখিত হলেও তারজন্য দায়ী  তাবড়দের দিকে কেন বিন্দুমাত্র আঁচ পড়ল না তদন্তের ? প্রশ্ন জোরালোভাবেই উঠেছে। 
গ্রামে অবশেষ পা পড়েছে বিজেপি’র। তারা নাকি শহীদ বেদী বানিয়েছে। ২১ মার্চ ‘শ্রদ্ধা’ জানাবেন বিরোধী দলনেতা। উদ্দেশ্য দুধের শিশুও বুঝছে। তবে গ্রাম নির্লিপ্ত। এক প্রবীণই জানালেন, ‘‘যে আসতে চায় আসুক। আমরা সব বুঝি। স্বাগত জানানোরও কিছু নেই। বাধাও দেব না।’’  অথচ ঘটনার পর প্রথম পুলিশ ছাড়া বরং পুলিশের বাধা টপকে গ্রামে পৌঁছেছিলেন, নৃশংসতার ভরকেন্দ্র প্রথম পা দিয়েছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। গ্রামের মানুষের মনে সেই স্মৃতি এখনও টাটকা। ঘটনার পরদিন থেকেই একমাত্র সিপিআই(এম) দাবি করে আসছে, ‘রাঘব বোয়ালদের ধরতে হবে।’ গ্রামের মানুষও যার সাথে সহমত। বগটুইয়ের যেকোনও অলি-গলিতে পৌঁছালেই যার প্রমাণ মিলবে। সেই দাবি নিয়েই সিবিআই’র অস্থায়ী কার্যালয় অভিযান থেকে গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় ঘুরেছে লাল ঝান্ডার মিছিল। আর আজ বগটুইয়ের স্বজনহারাদের প্রতি দরদ উথলে উঠেছে কারো কারো! শহীদ বেদীর কথা মনে পড়েছে আচমকা।
এই একবছর বগটুই অনেক বদলেছে। গ্রামের মানুষ শিক্ষা নিয়েছেন। চোখ বুঝে, মুখ বন্ধ রাখার বাঁধন ছিন্ন করেছেন। গ্রাম হয়েছে সজাগ, সতর্ক। প্রমান ষাটোর্ধ্ব কালাম শেখ। লাঠি ধরেই চলাচল তাঁর। নড়বড়ে শরীরে নতুন করে জেদ এনেছেন, ‘‘অনেক হয়েছে। অনেক সহ্য করলাম। আর অত্যাচার সইছে না। এর শেষ হওয়া দরকার।’’ বগটুইয়ের নাম শুনলেই মানুষের মনে ভেসে উঠত লুঠতরাজের ছবি। বগটুই মানেই যেন ছিল বোমা-বন্দুকের আখড়া। হিংসার সচ্ছল জনপদ ছিল বগটুই। নৃশংস হত্যালীলা অবশেষে বদল এনেছে বগটুইয়ের চরিত্র। বগটুইয়ে নতুন সূর্যোদয়ের ইঙ্গিত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।  
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0