অশোক ভট্টাচার্য
মহিলা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের আগের কয়েকদিন ধরে এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠা ঘিরে ছিল মনকে—পারবে কি ভারত? আশা ছিল, বিশ্বাসও ছিল, আর সেই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছিল সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মতো সাতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারানোর ঘটনা। মনে মনে ভাবতাম, ফাইনালে না পারলেও এত বড় শক্তিকে হারানোই বা কি কম গৌরবের? তবু অন্তরের গভীরে জেদ ছিল—এইবারই হবে, এইবারই ইতিহাস লিখবে ভারতীয় মেয়েরা। ভারতীয় দর্শকরা বহুবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা দেখেছে—সৌরভের, রোহিতের টিম— দু’বার বিশ্বকাপ হাতছাড়া। কিন্তু এবার লড়াইটা ছিল ভিন্ন। এটি ছিল শুধু ক্রিকেট ম্যাচ নয়; ছিল লিঙ্গ-সমতার দাবির লড়াই, সমাজের চোখ রাঙানি, বিদ্রূপ আর অবহেলাকে ছাপিয়ে উঠে দাঁড়াবার বীরগাথা। প্রতিটি খেলোয়াড়ের চোখে ছিল জয়ের ক্ষুধা, ছিল এক অদম্য জেদ। আর এই জেদই তাদের জয়ের পথে নিয়ে গেছে—এটি নিঃসন্দেহে একটি জেদের জয়। ফাইনালের দিন কোটি কোটি মানুষের চোখে একই উজ্জ্বলতা, একই অস্থিরতা। যেন প্রতিটি ভারতীয় মেয়ের বুকে জমে থাকা অপমান, বঞ্চনা, বিদ্রূপ আর প্রতিদিনের লড়াই সেই মাঠে রূপ নিচ্ছিল ব্যাট–বলের ভাষায়। এই জয় তাই কেবল ক্রিকেটের নয়—এটি অস্তিত্বের জয়, সম্মানের জয়, এবং সর্বোপরি জেদের জয়।
চলচ্চিত্রের আদর্শ, বাস্তবের সংগ্রাম
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ‘কোনি’র তীব্র স্লোগান—‘ফাইট, কোনি, ফাইট!’ মনে পড়েছিল ‘চক দে ইন্ডিয়া’র মেয়েদের চোখের সেই তীব্র ক্ষুধা— নিজেদের প্রমাণ করার ক্ষুধা। মনে পড়েছিল ‘লগান’-এর লড়াই—ক্ষমতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
এই ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল ঠিক তেমনই— মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, অনেকে সমাজের তিরস্কার সহ্য করে ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়েছে। ক্রিকেট তো ছেলেদের খেলা—এমন কথা কে না শুনেছে তারা? পাড়ায় খেলা মানেই উপহাস, ট্রেনিং মানেই প্রশ্নবোধক চোখ—‘মেয়েমানুষ ক্রিকেট খেলবে?’ কিন্তু জেদ—সেই অগ্নিকণা—তাদের থামতে দেয়নি। কারণ স্বপ্ন বর্ণ দেখে না, স্বপ্ন লিঙ্গ দেখে না।
ঝুলনের থেকেও বড় হয়ে ওঠা অনুপ্রেরণা
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতের মেয়েদের ক্রিকেট মানেই আমাদের মনে প্রথমেই ভেসে ওঠে ঝুলন গোস্বামীর নাম। তাকে চিনি বহুদিন। মনে আছে, একদিন বলেছিল—‘রিচার দিকে নজর রাখুন, ও একদিন বড় হবে।’
আজ তা বাস্তব। শিলিগুড়ির মেয়ে রিচা ঘোষ শুধু ভারত নয়, বিশ্বের ক্রিকেট–মানচিত্রে আলো ছড়াচ্ছে। ওর পরিবারকে বহুদিন ধরে চিনি। বিলাসিতা নেই, বড়লোকি নেই—আছে পরিশ্রম, সততা আর স্বপ্ন। রিচা ভালো খেললে ওর বাবা বলেন—‘সবটাই আপনাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদের ফল।’
এই সারল্য, এই আত্মবিশ্বাসই রিচাদের আসল শক্তি। আজ ঝুলন শুধু একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার নয়—তিনি দেশের ক্রিকেটারদের ‘ঝুলুদি’, পথপ্রদর্শক, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন— গ্রাম থেকেও বিশ্বজয় সম্ভব।
শিলিগুড়ি—এক ছোট শহরের বড় স্বপ্ন
বাংলা থেকে জাতীয় দলে যারা জায়গা পেয়েছে—ঋদ্ধিমান সাহা, রিচা ঘোষ, মান্তু ঘোষ—অদ্ভুত মিল, এরা সবাই শিলিগুড়ির সন্তান। এ শহর কখনো বড় বড় কর্পোরেট সুবিধা পায়নি, বড় অ্যাকাডেমির দয়া পায়নি। ছোট ছোট মাঠ, ক্লাব, কোচের উৎসাহ আর নিজের জেদে তৈরি হয়েছে এরা।
ক্রীড়াক্ষেত্রে শিলিগুড়ির উন্নয়নের মূল ভিত্তি হয়েছিল বাম সরকারের সময়—কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন, সুইমিং পুল, লন টেনিস কোর্ট, ইনডোর স্টেডিয়াম—সবই সেই আমলের সৃষ্টি। সেই সময় কাউয়াখালিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়—পরবর্তী সরকার এসে সব কিছু উপেক্ষিত করে দিয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন আজ বড় কোনও ম্যাচ পায় না, লন টেনিস কোর্ট জঙ্গলে ঢেকে পড়ে আছে, ইন্ডোর স্টেডিয়ামে টেবিল টেনিস অনুশীলন হয় না।
আর যেটা সবচেয়ে বেদনাদায়ক
স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং সেন্টারও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেখানে স্টেডিয়াম বন্ধ, সেখানে ২০০ কোটি টাকার শিবলিঙ্গ। আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন— সরকারি জমিতে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করে বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপন করবেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—শিলিগুড়িতে ক্রীড়া–অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে, দক্ষ খেলোয়াড়রা সুযোগ না পেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ধর্মস্থাপনার জন্য ২০০ কোটি—আর খেলাধুলার জন্য কিছুই নয় কেন?
এটা ধর্মের বিরোধিতা নয়— এটা বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যেসব অবাস্তব ক্লাবগুলিকে বছরে কোটি কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়, তাদের কাজ কোথায়? ক্রীড়া উন্নয়নে কী অবদান? যে শহর ঋদ্ধিমান, রিচা, মান্তুদের তৈরি করে, সেই শহরের মাঠ-স্টেডিয়াম নিঃশব্দে মরছে আর সরকার ব্যস্ত মূর্তি বসাতে। এভাবে কখনোই ক্রীড়া–সমৃদ্ধি আসে না। বীর জন্মায় না। স্বপ্ন বাঁচে না।
অতীতের সৃষ্টি আজ ধ্বংসের পথে
যখন আমি বিধায়ক ছিলাম, তখন তৈরি হয়েছিল ‘ক্রীড়াদীপ্তি’—একটি স্পোর্টস মিউজিয়াম। উদ্দেশ্য ছিল—শিলিগুড়ির ক্রীড়া–গৌরবকে তুলে ধরা, নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেওয়া। আজ সেটিও অন্ধকারে, তালাবদ্ধ, বিস্মৃত। তবু, এই অবহেলা, উপেক্ষা, রুদ্ধদ্বার সুযোগের মাঝেই উঠে এসেছে রিচারা। কারণ—জেদ যেখানে আছে, সেখানে বাধা কখনও জয়ী হতে পারে না।
শেষ কথা
আজকের এই বিশ্বজয় শুধুই ট্রফি নয়— এটি ভারতীয় নারীসত্তার বিদ্রোহ, সাহসের মুকুট। তারা বলে দিল—বাধা যতই থাক, সুযোগ যতই কম হোক—স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, জেদ যদি অটল হয়, তবে জয় সুনিশ্চিত। আজ সমগ্র ভারতের মেয়েদের কাছে এই দল একটাই বার্তা রেখে গেল—ভয় নয়, জেদ নিয়ে বাঁচো। কারণ এটি—একটি জেদের জয়।
Comments :0