সুপ্রিম কোর্ট মোটেই নোটবাতিল পরিণতিকে সিলমোহর দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শুধুমাত্র নোটবাতিল সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের আইনি বৈধতার প্রশ্নে রায় দিয়েছে। বস্তুত, নোটবাতিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে রায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত, ওই সিদ্ধান্তের পরিণতি নিয়ে কোনও মতামত দেয়নি। নোটবাতিল সংক্রান্ত শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের রায় সম্পর্কে এদিন এমনই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সিপিআই(এম), কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলি।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎই ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটবাতিলের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর আকার নেয়। এমন হঠকারী পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকার নিতে পারে কীনা, সেই নিয়েই মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। এদিন সেই মামলার রায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
এসম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এদিন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে বলেছে, নোটবাতিলের পদক্ষেপ সঠিক, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের এমন ব্যাখ্যা দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না। বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের একমাত্র আইনি অধিকারের প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে যে ওই পদক্ষেপ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ১৯৩৪ সালের আইনের ২৬(২) ধারা মোটেই লঙ্ঘন করেনি। পাঁচ বিচারপতির মধ্যে যিনি ভিন্নমত পোষণ করেছেন তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ওই ধারাতেই বলা আছে যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই সরকারকে নোটবাতিলে উদ্যোগী হওয়ার সুপারিশ করা উচিত। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে একমাত্র মতামত চাওয়া হয়েছিল। পলিট ব্যুরো মনে করে, ওই সিদ্ধান্ত রূপায়ণের আগে সংসদের অনুমোদন নেওয়া উচিত ছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় উল্লেখ করেছে যে, নোটবাতিলের সঙ্গে যে উদ্দেশ্যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ যোগসূত্র থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে কি হয়নি, তা প্রাসঙ্গিক নয়।
পলিট ব্যুরো মনে করে, সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় সরকারের সিদ্ধান্তের আইনি অধিকারকেই বজায় রেখেছে। এর পরিণতি নিয়ে কিছু বলেনি। নোটবাতিল ভারতের বিপুল অসংগঠিত অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে। অথচ এই ক্ষেত্রই রুটিরুজি জোগায় কোটি কোটি মানুষের। ক্ষুদ্রশিল্প, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়েছে। বিপুল পরিমাণ মানুষের রুটিরুজি ধ্বংস করেছে। রিপোর্টেই উল্লেখ আছে যে, ২০১৬ সালে নোটবাতিল ঘোষণার এক মাসের মধ্যে প্রাণ হারান ৮২জন। এছাড়া, ওই ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি হিসাবে দাবি করা হয়েছিল যে, এর ফলে কালো টাকা উদ্ধার হবে এবং বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে তা ফিরিয়ে আনা যাবে, জালনোট বন্ধ হবে, সন্ত্রাসবাদীদের অর্থ জোগান বন্ধ করে দেওয়া যাবে, দুর্নীতি প্রতিরোধের পাশাপাশি অর্থনীতিতে নগদ অর্থের লেনদেন কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। বাস্তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টই জানাচ্ছে, জনগণের হাতে নোটবাতিলের আগে ছিল ১৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা। আর এখন সেই অর্থ পৌঁছে গিয়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায়। অর্থাৎ নোটবাতিলে জনগণের হাতে অর্থের জোগান বেড়েছে ৭১.৮৪ শতাংশ।
পরিশেষে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো পরিষ্কারই বলেছে, শীর্ষ আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নোটবাতিল নিয়ে স্রেফ সরকারের সিদ্ধান্তের আইনি অধিকারের বিষয়টি বজায় রেখেছে। কোনোভাবেই ওই সিদ্ধান্তের পরিণতিকে অনুমোদন করেনি।
সিপিআই এদিন শীর্ষ আদালতের রায়কে ‘বিভাজিত’ অ্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, নোটবাতিল সম্পর্কে কেন্দ্রের মিথ্যা দাবির কথা বিবেচনা করা হয়নি। একমাত্র আইনি অধিকারের দিকটি দেখা হয়েছে। জনগণের ওপর এর ক্ষতিকর পরিণতির কথা বলা হয়নি।
কংগ্রেস মনে করে, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যদি নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে দাবি করা হয় তাহলে বিভ্রান্তিকর এবং ভুল হবে। এর পরিণতি নয়, শুধুমাত্র সিদ্ধান্তের নির্দিষ্ট কিছু আইনি বৈধতা নিয়ে রায় দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারের লক্ষ্যপূরণ হয়েছে এমন অভিমতও দেওয়া হয়নি এদিনের রায়ে। তবে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ এমন প্রতিক্রিয়া জানালেও দলের মুখপাত্র রণদীপ সূরযেওয়ালা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। জয়রাম রমেশের সুরেই দলের অন্যতম প্রবীণ নেতা পি চিদাম্বরম বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় উলটে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিল যে আদৌ নোটবাতিলের লক্ষ্যপূরণ হয়েছে কীনা! আবার যে বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করেছেন তিনি তো নোটবাতিলের বেআইনি এবং বেনিয়ম নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।
Comments :0