EDUCATION ROUND UP

মন্ত্রীর জেল, পর্ষদ সভাপতিরও!

রাজ্য

EDUCATION ROUND UP

‘‘লেখা পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’’
‘‘লেখা পড়া করে যে অনাহারে মরে সে।’’
‘‘লেখা পড়া করে যে রাস্তায় বসে আন্দোলন করে সে।’’
তিনটি আলাদা আলাদা লাইন। প্রথমটা ছোট বেলায় মা ঠাকুমাদের মুখে শোনা। দ্বিতীয়টা সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমায় শোনা। আর তৃতীয়। হ্যাঁ। তৃতীয়টাই আজ বাস্তব।
দুর্নীতি থেকে ভুয়ো শিক্ষক। এমনই সব কথা সামনে এনে ফেলেছে।  


প্রায় ৬৫০ দিন। একটা আন্দোলনের বয়স। শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে  আন্দোলন। কাদের আন্দোলন? যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের। বলা ভালো হবু শিক্ষকদের। যাঁরা পাশ করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু ঘুষ দিতে পারেননি বলে চাকরি হয়নি। 
২০২২ সাল। সাধারণ ভাবে একটা সংখ্যা। কিন্তু এই সংখ্যা বা বছরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুর্নীতি। বেনজির শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন দুর্নীতি। শিক্ষক পদে চাকরি নিয়ে দুর্নীতি। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার হওয়ার পর থেকেই চলেছে কলেজে ভর্তির জন্য ঘুষ নেওয়া। চড়চড়িয়ে বেড়েছে রেট। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকারের প্রতিটি নিয়োগের পরীক্ষা ঘিরে বাতাস ভারী হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। একে তো নিয়মিত পরীক্ষা হয়নি, যেমন প্রতি বছর হতো বামফ্রন্ট সরকারের সময়। যেটুকু হয়েছে, তাতেও টাকার লেনদেন। 

 


২০২২, ২৩ জুলাই, শনিবার। সকাল ১০টা নাগাট গোটা বাংলা ব্রেকিং নিউজ দেখল। ‘‘এসএসসি দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।’’ তারপর একে একে গ্রেপ্তার হয়েছেন শিক্ষা দপ্তরের একের পর এক উচ্চপদস্থ কর্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় এখন জেলে এই দুর্নীতি মামলায়। সেই কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, যাঁর সই রয়েছে বিগত কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ মাধ্যমিক পাশ করা ছেলে মেয়েদের মার্ক শিটে।  
২০১৭ সালে শেষবার এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে রাজ্যে। ব্যস এখানেই শেষ। তারপর আর কোনও পরীক্ষা হয়নি। আর এই পরীক্ষাকে এবং তার নিয়োগকে কেন্দ্র করেই ভুড়ি ভুড়ি দুর্নীতি। মন্ত্রীর বাড়িতে উদ্ধার হচ্ছে টাকার পাহাড়। রাত জেগে টাকা গোনার মেশিনে গোনা হচ্ছে টাকা। কিন্তু তাও শেষ হচ্ছে না। অনেকটা সেই আলি বাবা চল্লিশ চোরের গুপ্ত গুহার মতো। 
কিন্তু এটা কি একদিনের বিষয়? না। দীর্ঘদিন ধরে চলেছে এই দুর্নীতি। যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ হয়েছে বারবার। প্রাথমিকে টেট থেকে এসএসসি। এই দফায় ২০১৯ সাল থেকে এসএসসি চাকরি প্রার্থীরা প্রথমে প্রেস ক্লাবের সামনে, তারপর গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বসে রয়েছেন। 


লাগাতার আন্দোলন চলেছে চাকরির দাবিতে। কখনও কালিঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে অবস্থান তো কখনও বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থা। চাকরি প্রার্থীদের এই আন্দোলনের ওপর নেমে এসেছে পুলিশি অত্যাচার। 
২০ অক্টোবর, ২০২২। প্রাথমিকের চাকরি প্রার্থীরা ৬২ ঘন্টা টানা বিকাশ ভবনের সামনে। ২০১৪’র পরীক্ষায় পাশ করার ৮ বছর পরও পাননি নিয়োগপত্র। শান্তিপূর্ণ  অবস্থান চালানোর পর রাত ১২ টা নাগাদ জোড় করে টেনে হিঁচড়ে চাকরি প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে চলতে থাকে পুলিশি অত্যাচার। আহত হন অনেকে। গাড়ির চাকার তলায় শুয়ে বিক্ষোভ দেখান আন্দোলনকারীরা। এক্সাইড হোক বা কালীঘাট সব জায়গাতেই ধরা পড়েছে একই ছবি। 
৪ নভেম্বর অবস্থানের ৬০০ দিনের দিন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে চাকরি প্রার্থীদের যখন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা জানতে চায় তাদের দাবি কি? সন্তান কোলে নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নাসরিক বানু বলেন, ‘‘আমরা শুধু আমাদের চাকরি চাই। আর চাই মুখ্যমন্ত্রী আসুক আমাদের কথা শুনতে।’’ নাসরিক বানুর মতো বহু চাকরি প্রার্থী নিজেদের সন্তানকে সাথে নিয়ে আসেন এই ধর্ণা মঞ্চে। মায়েদের সাথে আসা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলো বাকি আন্দোলনকারিদের মাসি, মামা বলে ডাকে। ওরাও মা, মাসি, মামাদের সাথে স্লোগান তোলে ‘চাকরি চাই চাকরি দাও।’   
কিন্তু চাকরি প্রার্থীরা চাইলেও মুখ্যমন্ত্রী আসেন না ধর্ণা মঞ্চে। তিনি রেড রোডে পুজো কার্নিভালে যান। হাততালি দেন দলীয় সাংসদ বিধায়ক নুসরত, মিমি, জুন মালিয়াদের সাথে। তাদের সাথে নাচেন মজা করেন। কিন্তু ধর্না মঞ্চে যান না। আর সেই ধর্ণা মঞ্চ লোক চক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য সেইদিন সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা হয় গান্ধী মূর্তির পাদদেশ।     

 


দুর্নীতির জাল আরও ছড়িয়ে। প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির ছায়া ধরা পড়েছে এই বছরে। রায় দিবেছে আদালত। সরকার নিজে সমানে চেষ্টা চালিয়েছে দুর্নীতিকে আদালতে আড়াল করার। 
২০১৪ সালে টেট পরীক্ষায় সাদা খাতা দিয়ে চাকরি পেয়েছে এমন অনেকই আছে। এই দুর্নীতিতেও নাম জড়িয়ে শাসক দলের বিধায়ক এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের। ব্যাঙের ছাতার মতো তাঁর সহায়তায় একের পর এক টিচার্স ট্রেনিং কলেজ গজিয়ে উঠেছে। যেখানে ছাত্র ভর্তি নিয়েও রয়েছে টাকা নেওয়ার অভিযোগ। এখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো তিনিও জেলে।
বামপন্থীরা বার বার অভিযোগ করেছেন রাজ্যের সর্বত্র, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। সেই সত্যি ফুটে বেরচ্ছে রোজ। ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাই কোর্টের পক্ষ থেকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। আদালতের রায়ে একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশে এখন স্পষ্ট বামপন্থীদের বক্তব্য। সারদায় সিবিআই তদন্ত আটকাতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেমন সরকার ছুটে ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রেও সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করে মমতা ব্যানার্জির সরকার। দাবি ছিল সিআইডি বা রাজ্য পুলিশ দিয়ে হোক তদন্ত। 
এসএলএসটি’র ক্ষেত্রে২৩,৭১১ টি পদে নিয়োগ হলেও ৭০০০ এর বেশি ভুয়ো নিয়োগের তালিকা আদালতের কাছে জমা দিয়েছে ইডি এবং সিবিআই। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ৭ নভেম্বরের মধ্যে ভুয়ো শিক্ষকদের ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দিলে দেখা যায় একাধিক স্কুলে ভুয়ো শিক্ষকরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। 
জুলাই মাসে পার্থ গ্রেপ্তার। পুজোর আগে এক ঝাঁক শিক্ষা কর্তা গ্রেপ্তার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আসল মাথাকে ধরতে পারল না সিবিআই। 


ক্যাপশন: চাকরিপ্রার্থীদের ধর্ণামঞ্চ। ছবি: অমিত কর

 

Comments :0

Login to leave a comment