চিন্ময় কর: গড়বেতা
পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা থানার এক গ্রামে মূক ও বধির তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতে তৎপর হলো তৃণমূল ও বিজেপি। সালিশি সভার মাধ্যমে তৃণমূল ও বিজেপি নেতা-কমীরা একযোগে থানাকে নিয়ন্ত্রণের তোড়জোড় চালালো দু’দিন ধরে। শুধু তাই নয়, ধর্ষিতার পরিবারকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে এই বর্বরোচিত ঘটনার ‘মিটমাট’ করে নেওয়ার জন্য তৃণমূল ও বিজেপি’র কর্মীরা চাপ দেয় বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। টাকা নেওয়ার যুক্তি হিসাবে অসহায় ওই পরিবারকে বলা হয়েছে, ‘‘থানা-পুলিশ হলে মেয়েটির তো বটেই, সঙ্গে পরিবারেরও মানসম্মান নষ্ট হবে।’’ একইসঙ্গে ঘটনা ‘সামলে দেওয়ার’ জন্য অভিযুক্ত যুবকের পরিবারের কাছে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করা হয় বলেও খবর। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ায় তৃণমূল ও বিজেপি নেতাদের সব চেষ্টাই ভেস্তে যায়।
পুরো ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের বক্তব্য, অভিযোগ পেয়েও গ্রামে আসতে দেরি করেছে পুলিশ। ঘটনা নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় এবং সাংবাদিকরা জেনে ফেলায় শেষপর্যন্ত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এত কিছু সত্ত্বেও শনিবার ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা চালায় পুলিশ। শনিবার সকালে গড়বেতা থানার চন্দ্রকোনা পুলিশ ফাঁড়িতে এই ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ দায়ের হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে পুলিশ জবাব দেয়, ‘‘এমন কোনও ঘটনা আমাদের জানা নেই।’’ অথচ শনিবারই দুপুরের পর ধর্ষণে অভিযুক্ত যুবককে গড়বেতা আদালতে হাজির করায় পুলিশ। এই যুবকের চার দিনের পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গড়বেতা থানার চন্দ্রকোনা রোড ফাঁড়ি এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্ত মেয়েটি গরিব পরিবারের। মূক ও বধির এই মেয়ের বাবা কামারশালা চালিয়ে সংসার নির্বাহ করেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২৬ বছর বয়সি এই তরুণী ভূষিমাল দোকানে জিনিষপত্র কিনতে গিয়েছিলেন। অভিযুক্ত বছর ২৪’র যুবক অভিজিৎ শীল তাদের দোকানঘরে ওই যুবতীকে জোরজবরদস্তি ধর্ষণ ও নির্যাতন করে বলে অভিযোগ। সেদিন সকাল থেকেই অভিযুক্ত যুবকের বাবা-মা সহ পরিবারের সকলে ছিলেন বাড়ির বাইরে। তার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে। ধর্ষিতা তরুণী সেই দোকানঘরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভিযুক্ত ছেলেটি তখন তাঁকে দোকানঘরে আটকে বাইরে তালা লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে চলে যায়।
এরপর যুবকটি দোকান খুলে ভিতরে ঢুকলে ওই তরুণী রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরে বের হয়ে আসেন। বাড়িতে পৌঁছে কান্নাকাটি করে সমস্ত ঘটনা জানান। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা দিলীপ রায় ও বিজেপি নেতা মানস রায়ের পরামর্শে অভিযুক্ত যুবক গা-ঢাকা দেয়। পাশাপাশি ধর্ষিতা তরুণীর পরিবারকে ডেকে সালিশি সভার মাধ্যমে তাঁদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চলে। তবে ততক্ষণে পুলিশে খবর পৌঁছে দেন গ্রামের মানুষ। জানা গিয়েছে, মেয়েটির বাবাও ফোনে অভিযোগ করেন পুলিশকে। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা পর শুক্রবার রাতে অভিযুক্ত যুবককে পুলিশ তুলে নিয়ে আসে।
অভিযোগ, সালিশি সভায় ওই দুই নেতা সহ তৃণমূল ও বিজেপি’র মাতব্বররা অভিযুক্ত যুবকের পরিবারের কাছে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করে। কিন্তু যুবকের বাবা দিবেন্দু শীল জানান, তিনি এত টাকা দিতে পারবেন না। সামান্য ভূষিমালের দোকান চালিয়ে সংসার চলে তাঁর পরিবারের। ছেলে দোষ করলে তার শাস্তি হবে। তিনি একথা বলায় বানচাল হয়ে যায় ১৫ লক্ষ টাকা হাতানোর ফন্দি। একইসঙ্গে এই ঘটনার কথা সাংবাদিকরাও জেনে ফেলায় পুলিশ প্রশাসনও কিছুটা তৎপর হয়। তারপরেই গ্রামে গিয়ে অভিযুক্ত যুবককে তুলে নিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী।
শনিবার দুপুরের পর গড়বেতা আদালতে তোলা হয় যুবককে। নির্যাতিতা তরুণীকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। পরে শনিবার সন্ধ্যায় তরুণী বাড়িতে ফিরেছেন বলে জানা যায়। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদক নাসিমা বিবি এই ঘটনায় তীব্র ধিক্কার জানিয়ে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। সালিশি সভায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও আইনি পদক্ষেপ দাবি করেছেন তিনি।
Comments :0