‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই পুলিশ আমাকে ধরে এনেছে, মিথ্যা কেস সাজিয়েছে এবং নির্যাতন করেছে।’ লালবাজারে কলকাতা পুলিশের হেপাজতে বন্দি অবস্থায় পুলিশ অফিসারদের সামনেই নিজের পরিবারের সদস্যদের একথা বলেছেন ভাঙড়ের বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি। লালবাজার থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের কাছে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমাদের একান্তে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের সামনেই পীরজাদা নৌশাদ সিদ্দিকি জানিয়েছেন যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই তাঁর ওপর অত্যাচার হয়েছে। তাঁর শরীরে আঘাত রয়েছে, কিন্তু চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা হয়নি।’
আইএসএফ’র প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে ধর্মতলায় যাওয়ার পথে ভাঙড়ের হাতিশালায় আইএসএফ কর্মীদের ওপরে এবং নৌশাদ সিদ্দিকির ওপরে হামলা করে তৃণমূলের আরাবুল ইসলামের বাহিনী। তারপরে ধর্মতলায় প্রতিবাদের সময় কলকাতা পুলিশ লাঠি চালিয়ে নৌশাদ সিদ্দিকি সহ ১৯জনকে গ্রেপ্তার করেছে, পুলিশ তাঁদের জামিনের বিরোধিতা করায় ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি হেপাজতে রাখা হয়েছে। এরফলে শুধু ভাঙড় নয়, সারা রাজ্যেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিমান বসু এবং সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও বিরোধীদের কণ্ঠরোধ ও অধিকার কেড়ে নেওয়ায় তৃণমূল ও সরকারকে ধিক্কার জানিয়েছেন। মঙ্গলবার লালবাজারে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী গিয়েছিলেন নৌশাদ সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে দেখা করতে দেয়নি। পুলিশ কেবলমাত্র নৌশাদ সিদ্দিকির পরিবারের তিনজনকে তাঁর সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য দেখা করতে দেয়। তবে পুলিশের অফিসারদের উপস্থিতিতেই তাঁদের কথা বলতে হয়েছে।
লালবাজারে এদিন কঠোর পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুপুরে সেখানে ফুরফুরা শরিফ থেকে এসে উপস্থিত হন নৌশাদ সিদ্দিকির তিন ভাই কাশেম সিদ্দিকি, নাজমূল সিদ্দিকি, ত্বহা সিদ্দিকি। পুলিশ তাঁদের নাম পরিচয় নথিভুক্ত করে ভিতরে নৌশাদ সিদ্দিকির কাছে নিয়ে যায়। লালবাজারের কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর থেকে বেরিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন কাশেম সিদ্দিকি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ফুরফুরা শরিফ থেকে আমাদের পাঠানো হয়েছিল গভীর উদ্বেগ নিয়ে। আমরা এসে দেখছি, নৌশাদের শরীরে চোট আঘাত রয়েছে। মাথায় আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা হচ্ছে না। নৌশাদ সিদ্দিকি আমাদের চিৎকার করে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কথায় পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কেস সাজিয়েছে। তাঁর নির্দেশে পুলিশ আমাকে তুলে এনেছে, লাঞ্ছিত করেছে।
তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যরাও বলেছেন, আমরা আইনকানুনকে সম্মান দিই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আইন মানেন না। তাই বিধায়ক এবং পীরজাদাকে এভাবে পুলিশ মেরেছে। ধৃত আইএসএফ নেতা বিশ্বজিৎ মাইতির চোখ অপারেশনের পরে ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন ছিল, তাও দিতে দেওয়া হয়নি। বিজেপি শাসিত রাজ্যে যেভাবে পুলিশি হামলা হয় সেইভাবে হামলা হয়েছে পীরজাদার ওপরে। মুখ্যমন্ত্রী ভোটের আগে একরকম সেজেছিলেন, এখন ফুরফুরা শরিফকে আক্রমণ করছেন।
সুজন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেছেন, নৌশাদ সিদ্দিকি এরাজ্যের বিধানসভার একমাত্র বিধায়ক যিনি শাসকদলের নন, তাঁকে লালবাজারে যেভাবে আটকে রাখা হয়েছে আমরা তার নিন্দা করি। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, কিন্তু আমাকে দেখা করতে দেয়নি। হয়তো নবান্নের নির্দেশ নেই তাই। অন্য কেউ হলে, অনুব্রত মণ্ডল হলে স্পেশাল ব্যবস্থা হতো। বিরোধীদের খালি পেটাবে? অনুব্রত মণ্ডল যদি পুলিশ হেপাজতে জামাই আদর পেতে পারে, তাহলে একজন বিধায়কের জন্য আলাদা ব্যবস্থা কেন? এটা হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ ওঠবস করে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। মুখ্যমন্ত্রী যা করছেন তাতে বিজেপি খুশি হচ্ছে।
দুর্নীতির দায়ে তৃণমূলের মন্ত্রী বিধায়কদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে এর আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, নৌশাদ সিদ্দিকিকে আইন মেনেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিয়ম হলো গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিধানসভাকে জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রেও জানানো হয়েছে। আমরা বিধানসভার বুলেটিনে সেটা প্রকাশ করে দেব। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। একজন বিধায়ক, তাঁর দল রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করবে, আর বিধায়ক ধর্মের আড়ালে সুরক্ষা চাইবেন, সেটা হতে পারে না।
এদিকে ভাঙড়ের বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি সহ আইএসএফ কর্মীদের ওপরে হামলা, পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আইএসএফ’এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ মিছিল করা হয়েছে মঙ্গলবার। দেগঙ্গায় বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে একযোগে মিছিল করেছেন আইএসএফ কর্মীরা। আইএসএফ’এর কার্যকরী সভাপতি সামশুল মল্লিক জানিয়েছেন, রাজ্য নেতৃত্বের বৈঠকের পরে স্থির হয়েছে, মিছিল হবে, বাড়িতে বাড়িতে প্রচার হবে। বিধায়ককে এভাবে আটক করা হলে মানুষের অধিকার কোথায়! ভাঙড়ের কর্মীরা এখনও সন্ত্রাসের মধ্যে রয়েছেন। অত্যাচারিতদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ শাসকদলের কথায় চলছে। এর প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের মিছিলে সবাই পা মেলান। পীরজাদাদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল প্রতিবাদের। তাঁরাও সাড়া দিচ্ছেন। আমরা বিজেপি’র মতো কোনও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড সমর্থন করি না।
বুধবার কলকাতায় আইএসএফ’এর পক্ষ থেকে নাগরিক মিছিলের আহবান জানানো হয়েছে। তৃণমূলের শাসনে রাজ্যে গণতন্ত্র ও মানুষের সাংবিধানিক অধিকার আক্রান্ত বলে বলে প্রতিবাদে সবাইকে শামিল হতে আহবান জানানো হয়েছে আইএসএফ’এর পক্ষ থেকে। সোমবারই ফুরফুরা শরিফে আইএসএফ’এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির বৈঠক হয়। তারপরে জানানো হয়েছে, আদালতে আইনি লড়াই চলছে। আমাদের বিচারব্যবস্থার ওপরে পূর্ণ আস্থা আছে। আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাস্তায় নেমে রাজ্য সরকারের এই চরম অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে হবে। সেজন্য দলীয় কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মিছিল করবেন, সভা করবেন, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার কর্মসূচি চালাবেন। সোশাল মিডিয়াতেও প্রচার করা হবে। ২৫ জানুয়ারি বুধবার দুপুর দু'টোয় শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে একটি নাগরিক মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। সেই মিছিলের দাবি, জনপ্রতিনিধি নৌশাদ সিদ্দিকি সহ সমস্ত আইএসএফ কর্মীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে ও ভাঙড়ে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আইএসএফ সংবিধান বাঁচাও দিবস পালন করবে। ২৯ তারিখে অগণতান্ত্রিকভাবে আটক করা বন্দিদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবিতে রাজ্যের বিভিন্ন থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হবে। এছাড়াও রাজ্যপালের কাছেও ডেপুটেশন দেওয়ার এবং একটি কনভেনশন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
Comments :0