Editorial

যুদ্ধের আঁচ

সম্পাদকীয় বিভাগ

মোদী সরকারের অতিরিক্ত ইজরায়েলী প্রেমের জন্য ভারত তথা ভারতের জনগণকে অনেক খেসারত দিতে হবে। প্রায় দু’বছর ধরে গাজায় নৃশংসতা, বর্বরতা ও অমানবিকতার সব সীমা ছাড়িয়ে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি নিরীহ মানুষকে খুন করেছে ইজরায়েল। এখনও সেই গণহত্যা অবিরাম চলছে। প্রতিদিন গড়ে তিন শতাধিক গাজা অধিবাসী প্যালেস্তাইনের মানুষকে হত্যা না করে রাতে ঘুমোতে যায় না ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। গাজাকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেবার অভিযান চলতে চলতে লেবানন এবং সিরিয়াতেও নরহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে ইজরায়েল। এখন তাদের হিংসা উন্মত্ততা আছড়ে পড়েছে ইরানের উপর। পালটা আঘাতে ইরানও অবশ্য ছেড়ে কথা বলছে না।
এই আঘাত পালটা আঘাতে যুদ্ধের যে দামামা বেজে উঠেছে তাতে গোটা মধ্য প্রাচ্যে আতঙ্কের ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। যুদ্ধের সরাসরি আঘাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে ধ্বংস ও মৃত্যুর যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে তাকে ছাড়িয়ে অবশিষ্ট বিশ্বে আঘাত হানছে অর্থনীতিতে। নতুন করে বড়সড় ধাক্কার মুখে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্য। করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াবার আগেই তিন বছর আগে শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। সে যুদ্ধ চলছে আজও। কবে তার ইতি ঘটবে কেউ জানে না। ২০ মাস আগে শুরু হয় ইজরায়েলের গাজা ধ্বংস ও গণহত্যা অভিযান। ইজরায়েল জানিয়ে দিয়েছে পুরো গাজা ধ্বংস করে জনহীন না করা পর্যন্ত তাদের পৈশাচিকতা থামবে না। মাঝখানে অল্প সময়ের জন্য হলেও দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে নেমে গিয়েছিল। অনেকটা ক্ষয়ক্ষতির পর অবশ্য থেমেছে। এবার শুরু হয়েছে ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ।
যুদ্ধ মানে অনিশ্চয়তা। বিশ্ব অর্থনীতির জোগান শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটনা। অর্থনৈ‍‌তিক কর্মকাণ্ডে ঝুঁকি বাড়ে। বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। উৎপাদনে শিথিলতা। ক্রয়-বিক্রয়ে অনীহা। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা অর্থনীতির গতি মন্থর করে দেয়। ফলে বৃদ্ধির হার কমে। কর্মসংস্থান বাড়ে না। আয় বৃদ্ধি থমকে যায়। এমনকি মানুষ কাজ হারান, রুজি বন্ধ হয়ে যায়। জিনিসের দাম বাড়ে। অর্থাৎ যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষ এবং নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির সামনে হতাশা ডেকে আনে। অবশ্য যুদ্ধ ধনী দেশের মুনাফা বাড়ায় অস্ত্র বিক্রি বাড়ার মধ্য দিয়ে।
ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাধারণ যুদ্ধজনিত সঙ্কট থেকে বেশি বিপর্যয়কর। আর সেটা ভারতের পক্ষে একটু বেশি মাত্রায়। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের বৃহত্তম তেল ভাণ্ডার। বিশ্বের মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশের উৎস মধ্যপ্রাচ্য। সেই মধ্যপ্রাচের অন্যতম তেল ভাণ্ডার ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে এবং সেটা আরও ছড়ালে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম হুহু করে বাড়তে থাকবে। ইতিমধ্যেই তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভারত তার মোট জ্বালানির ৮০ শতাংশ আমদানি করে। তার বড় অংশই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে জ্বালানির জোগান কমবে এবং অনেক বেশি দাম দিয়ে তেল কিনতে হবে। স্বাভাবিকভাবে দেশে তেলের দাম বাড়বে অথবা সরকারের জনকল্যাণ খাতে ব্যয় ছাঁটাই হয়ে যাবে। তাছাড়া উপসাগরে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল সহ অন্যান্য পণ্যের জাহাজের চলাচল বন্ধ হবে। ঘুর পথে চলাচলের জন্য ব্যয় বাড়বে। ফলে ভারতের রপ্তানি কমে যাবে, আমদানি ব্যয় বাড়বে। তার ধাক্কায় বাড়বে জিনিসের দাম। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে বড়সড় ধাক্কা আসবে। তার সামগ্রিক বোঝা এসে চাপবে সাধারণ মানুষের ওপর। যুদ্ধের পরিণতির শিকার হলেও যুদ্ধ বন্ধে মোদীর ভারত কোনও ভূমিকা নিতে রাজি নয়। যুদ্ধের নিন্দা যেমন করবে না, তেমনি যুদ্ধ বন্ধের দাবিও করবে না। তাতে আক্রমণকারী ইজরায়েল স্তব্ধ হতে পারে। ইজরায়েলের স্বার্থের কথা ভেবে মোদী সরকার ভারতে সমূহ ক্ষতি নীরবে হজম করছে।

Comments :0

Login to leave a comment