মোদী সরকারের নোট বাতিলে বেনিয়মের অভিযোগ নিয়ে অবশেষে ছয় বছর বাদে রায় ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট। সোমবার পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের চার বিচারপতি সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে জানালেন, কেন্দ্রের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রের কোনও আইনি গলদ নেই। অন্যদিকে সংখ্যালঘু রায়ে এক বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে গলদ রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুরোপুরি বেআইনি। যে সিদ্ধান্ত আইন গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংসদে হওয়া উচিত ছিল তা নিছক নোটিস জারি করে ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিন বিচারপতিরা নোট বাতিলের উদ্দেশ্য সফল না বিফল তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পরিষ্কার চার বিচারপতি তাঁদের রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন, নোট বাতিল কালো টাকা উদ্ধার, সন্ত্রাসবাদী দমনের লক্ষ্যে হলেও সেই লক্ষ্য সফল নাকি ব্যর্থ হলো তা বিচার করার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে নাক গলানোর কোনও অধিকার নেই কোর্টের, তাও জানান সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা।
এদিকে নোট বাতিলে মোদী সরকারের বেনিয়মের যে তথ্য বারে বারে সামনে চলে এসেছে তা নিয়ে কার্যত নির্বাক থেকে গেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। সেই বেনিয়মের প্রশ্নে সরব থেকে সংখ্যালঘু রায়ে তা নির্দিষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিন পাঁচ সদস্যের বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগুরু চারজন বিচারপতি হলেন এস আবদুল নাজির, বি বি গাভাই, এ এস বোপান্না, ভি রামসুব্রহ্মণিয়ম। সংখ্যালঘু রায় দিয়েছেন বিচারপতি বি ভি নাগারত্না।
২০১৬সালের ৮নভেম্বর সন্ধ্যায় আচমকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের বোর্ড বৈঠকে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। নোট বাতিল হওয়ার পরের দিন ৯ নভেম্বর তার বিরোধিতা করে মামলা দায়ের হয় সুপ্রিম কোর্টে। সেসময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর মামলা বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর পরে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে মামলা। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন হয়। ডিসেম্বরে বেঞ্চে ফের মামলার শুনানি হয়। এর মধ্যে বেনিয়ম নিয়ে আরও ৫৮ মামলা দায়ের হয়। সব মামলা এক করে রায় হয়। সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে কেন্দ্রকে যাবতীয় তথ্য সুপ্রিম কোর্টে পেশের নির্দেশ দেয়।
কেন্দ্র ডিসেম্বরে কোর্টে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার তথ্য পেশ করলেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আপত্তির তথ্য গোপন করে যায়। তাদের ৮নভেম্বরে বোর্ড বৈঠকের আপত্তির নথি পেশ করেনি।
এদিন নোট বাতিলে কেন্দ্রের বেনিয়মের কথা রায়ে ভিন্নমত জানিয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন বিচারপতি বি ভি নাগারত্না। তিনি রায়ে বলেছেন, নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুরোপুরি বেআইনি। এই সিদ্ধান্ত হয়েছে কেন্দ্রের একতরফা নির্দেশে। ডিসেম্বরে কোর্টে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট বাতিল নিয়ে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা উল্লেখ করেন বিচারপতি। তিনি বলেন, কোর্টে পেশ করা বক্তব্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে কেন্দ্রের ইচ্ছা অনুসারে ৫০০এবং ১হাজার টাকার নোট বাতিল করার সুপারিশ জানিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তিনি এই বক্তব্য জানিয়ে বলেন এতে প্রমাণ হচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কার্যত চাপে পড়ে কেন্দ্রের নির্দেশ মতো সরকারের পক্ষে নোট বাতিলের সুপারিশ করেছে।
তার স্বাধীন মত গ্রহণ করা হয়নি। বক্তব্যে আরও স্পষ্ট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট বাতিল নিয়ে কোনও মাথা ঘামায়নি। কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট বাতিলের প্রক্রিয়া নিয়ে যে নথি পেশ করেছে তাতে আরও জানা গেছে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নোট বাতিলের মতো এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। নোট বাতিল মোদী সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত বোঝাতে তিনি নথি উল্লেখ করে বলেন, ২০১৬ সালের ৭নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে চিঠি পাঠায়। তাতে সরকার নোট বাতিলে তাদের মতামত জানিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতামত নেয়। এতে পরিষ্কার কেন্দ্রের নির্দেশ মতো নোট বাতিলের পক্ষে মত দেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু নোট বাতিলের দিনে বোর্ডের বৈঠকে তাতে আপত্তি জানানো হলেও তা মানেনি কেন্দ্র। এদিকে আরবিআই আইনের ২৬(২) ধারা অনুযায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট বাতিলের সেই সুপারিশ বেআইনি বলে জানান বিচারপতি। কারণ ২৬(২) ধারায় বলা আছে কোনও নোটের একটি সিরিজ বাতিল করতে হলে ঐ ধারায় তা বাতিল করা যায়। কিন্তু ৫০০ এবং ১০০০ টাকার সব নোট বাতিলের ক্ষমতা ঐ আইনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দেওয়া হয়নি।
এই নোট বাতিলে আইনে যে ব্যবস্থা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন বিচারপতি নাগারত্না। তিনি রায়ে বলেন, নোট বাতিল হয়েছে প্রশাসনিক নোটিস জারি করে। তা কখনো করা উচিত নয়। এই সিদ্ধান্ত আইন গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে করতে হবে। সংসদে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ছিল। আমাদের সংসদ হলো মিনি ভারত। তা গণতন্ত্রের পীঠস্থান। সেই সংসদকে এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রাখা যায় না।
এদিকে নোট বাতিলে মোদী সরকারের কালো টাকা উদ্ধার, জাল নোট উদ্ধারে মতো লক্ষ্য সফল বা বিফল নিয়ে চার বিচারক রায়ে কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও এতে বিরুদ্ধ মত জানিয়েছেন বিচারপতি নাগারত্না। তিনি তাঁর রায়ে বলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নথিতে জানিয়েছে, নোট বাতিলের পর ৫০০ এবং ১০০০ টাকার যত নোট বাজারে ছিল তার ৯৮ শতাংশ ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে। এর পরে ২০০০টাকার নোট ছাড়া হয়েছে। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কালো টাকা উদ্ধারের যে লক্ষ্য রাখা হয়েছিল তা সফল হয়নি।
এদিকে নোট বাতিলে রায়ে সরকারের সিদ্ধান্তে কোনও আইনের গলদ দেখেননি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। তাঁরা রায়ে বলেছেন, নোট বাতিলে যে নোটিস জারি করেছে সরকার, তাতে কোনও গলদ নেই। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতেও কোনও গলদ দেখা যায়নি। তাঁরা আরও জানান, ৫০০ এবং ১০০০টাকার নোট বাতিলে অযৌক্তিক কিছু নেই। এই সিদ্ধান্ত সরকারের আর্থিক নীতি নিয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। তা বদল করা যায় না। সংখ্যগরিষ্ঠ রায়ের পক্ষে বিচারপতি এস আবদুর নাজির বলেন, সরকারের আর্থিক নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা করার সময়ে অনেকটাই সংযত থাকা দরকার। এতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন তাঁদের প্রাজ্ঞতাকে মূল্য দিতে হবে।
Comments :0