মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর দল জন্মলগ্ন থেকেই বিজেপি’র ঘনিষ্ট। ১৯৯৮-’৯৯-এ অটলবিহারী বাজপেয়ীর তেরো মাসের সরকারে, পরে ১৯৯৯-র বিজেপি সরকারেও শরিক ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২০০১-এ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে তৃণমূল জোট বেঁধেছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। কিন্তু কলকাতা কর্পোরেশনে সেই সময়েও তাদের সঙ্গে বিজেপি’র জোট অক্ষুণ্ণ ছিল। তবে বিধানসভা নির্বাচনের পরে তিনি আবার ফিরে যান বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকারে। ২০০৪-র লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি’র সঙ্গেই ছিল। ২০০৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও তাই। ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন আজকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং। ২০১১-য় রাজ্যে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-র পরে মমতা ব্যানার্জিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি। তবু ‘কমিউনিস্ট’ নিধনের আহ্বানটিই যেন মমতা ব্যানার্জিকে মনে করিয়ে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন —‘‘প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে দিন।’’
প্রসঙ্গ অনুপ্রবেশ:
দিনটি ছিল ২০০৫-র ৪ আগস্ট। তৃণমূল কংগ্রেস তখন বিজেপি’র শরিক। তখন লোকসভায় সিপিআই(এম)’র দলনেতা ছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। উপাধ্যক্ষের মুখে কাগজ ছুঁড়ে মারার সেই আচরণ ঘিরে সংসদে তো বটেই, সারা দেশে ছি-ছিক্কার পড়ে গেছিল। সংসদের অধ্যক্ষ তখন ছিলেন সোমনাথ চ্যাটার্জি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির ওই আচরণের সময় তিনি অধ্যক্ষের চেয়ারে ছিলেন না। সংসদের কাজ সামলাচ্ছিলেন উপাধ্যক্ষ চরণজিৎ অটওয়াল। সংসদে তার কয়েকদিন আগেই বিজেপি’র তৎকালীন দলনেতা লালকৃষ্ণ আদবানি ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাব এনেছিলেন। আদবানির বক্তব্যে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম অনুপ্রবেশের কথা বারবার চলে এসেছিল সেই সময়ে। আদবানির মুলতুবি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পার্টির পক্ষ থেকে বাসুদেব আচারিয়া আলোচনা করেছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তখন বিজেপি জোটেই ছিলেন। ওদের সঙ্গেই বসতেন। যদিও মুলতুবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দিন মমতা ব্যানার্জি ছিলেন না। আচমকাই ৪ আগস্ট হাজির হন এবং ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে বলতে চান। তাঁর দাবি ছিল, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ হচ্ছে। সিপিআই(এম) অনুপ্রবেশে মদত দেয়। এবং অনুপ্রবেশকারীদের নাম ভোটার তালিকায় তুলে দেয়। প্রসঙ্গত, শুধু সংসদেই নয়। পশ্চিমবঙ্গে ‘অনুপ্রবেশ’ হয়, এই বক্তব্য মমতা ব্যানার্জি রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গ রামমন্দির:
২০০৪-র ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে এনডিএ’র নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ‘ভিশন ডকুমেন্ট’-এ ‘বেসিক মিশন অ্যান্ড কমিটমেন্ট’-এর মধ্যে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণকে এনডিএ’র অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সেই ইশ্তেহারে সই ছিল মমতা ব্যানার্জির। সেই ইশ্তেহার প্রকাশ করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সেদিন মঞ্চে জর্জ ফার্নান্ডেজের পাশে হাজির ছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র সরকারে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব করেছেন। সেই সূত্রেই ২০০৪-এ এনডিএ’র ইশ্তেহারে রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্য উল্লিখিত থাকলেও তাতে সই করতে কালক্ষেপ করেননি মমতা ব্যানার্জি। কেন করলেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন,‘‘আরে, রামমন্দির তো সাব জুডিশ ম্যাটার।’’ তাতে কী রামমন্দির নির্মাণ স্লোগানের চরিত্র বদলে যায়?
উল্লেখ্য, ওই ২০০৪-র ১১ এপ্রিল সিপিআই(এম) তৎকালীন রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাস মমতা ব্যানার্জি-আরএসএস’র বোঝাপড়া সম্পর্কে বলেছিলেন,‘‘আরএসএস’র পরগাছা হয়ে রাজ্যে কাজ করছে তৃণমূল কংগ্রেস।’’
এবারও রামমন্দির নির্মাণ, উদ্বোধনের সময় মমতা ব্যানার্জি নীরব থেকেছেন। বলেছেন শুধু একটিই প্রসঙ্গে। বারবার বলেছেন যে, তিনিও সরকারি টাকায় মন্দির বানাচ্ছেন, মন্দিরের সংস্কার করছেন। প্রায় ৭০০ কোটি টাকা তাঁর সরকার মন্দির বানানো, সংস্কারের কাজে খরচ করেছে বলে তিনিই জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গ: এনআরসি, সিএএ
জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রাথমিক কাজ অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়েই শুরু হয়েছিল। আর সেই মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
২০০০-র আগস্টে বামফ্রন্টের সাংসদ অবনী রায় রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব নিয়ে একটি প্রশ্ন করেন। জবাবে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী বিদ্যাসাগর রাও জানান যে, ‘‘সব নাগরিকের বাধ্যতামূলক পঞ্জিকরণ এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের একটি আইডেন্টিটি কার্ডের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকার বিবেচনা করছে।’’ সেই সময়ে সরকার বিজেপি’র। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। রেলমন্ত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জি।
তারপর ২০০৩। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করে এনডিএ সরকার। যুক্ত করা হয় ‘১৪এ’ ধারা। ওই ধারা অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজন মনে করলে প্রত্যেক ভারতবাসীর নাম নথিভুক্ত ও একইসঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের জন্য ‘ন্যাশনাল আইডেনটিটি কার্ড’ ইস্যু বাধ্যতামূলক করতে পারে। ২০০৩-র সেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আরও বলে দেওয়া হয়েছে যে, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অথরিটি তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজন মনে করলে প্রত্যেক দেশবাসীর জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে পারে।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি(এনআরসি)-র ভিত্তি হলো সেই সংশোধনী। সেই ভিত্তি তৈরি হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে। সেই মন্ত্রীসভাতেও ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২০০১-এ এনডিএ থেকে বেরিয়ে ফের ২০০৩-এ যোগ দেন বিজেপি’র সঙ্গে। তাঁর সমর্থনের ভিত্তিতে ওই সংক্রান্ত বিল পাশ হয়। তা আইনেও পরিণত হয়।
সেই আইন অনুসারে রুলস(বিধি)-ও তৈরি হয় সেই সময়কালে। তার নাম ‘দি সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশান অব সিটিজেন অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশানাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস-২০০৩।’ সেই রুলস কিংবা বিধির ৩নং ধারার শিরোনাম হলো — ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব ইন্ডিয়ান সিটিজেনস।’ সেই ৩নং ধারার ৪টি উপধারা। ৪নং উপধারায় বলা হয় —‘কেন্দ্রীয় সরকার, এই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ জারি করে, একটি সময়সীমা নির্দ্ধারণ করে, যারা লোকাল রেজিস্ট্রারের এলাকার মধ্যে থাকেন, সেই সব ব্যক্তিদের পপুলেশন রেজিস্ট্রার তৈরি করতে পারে।’
তখনই, ওই ২০০৩-এই এনপিআর’র কথা বলা ছিল। এবার মোদী-অমিত শাহ্ যখন এনআরসি’র জন্য উঠেপড়ে লাগলেন, এনপিআর-এও জোর দিলো কেন্দ্রীয় সরকার। এমন অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ থেকেই প্রথম এনপিআর-র বিরোধিতা ওঠে। তবে তা মমতা ব্যানার্জি করেননি। বিরোধিতা করেন বামপন্থীরা। মমতা ব্যানার্জি অবশ্য এনপিআর’র প্রশিক্ষণ শুরু করে দিয়েছিলেন। এনপিআর যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর(এনআরসি) ভিত্তি, তা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হওয়ার দিন তৃণমূল কংগ্রেসের ৬জন হাজিরই ছিলেন না সংসদে।
প্রসঙ্গ: ৩৭০নং ধারা
রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দি করে, বিপুল বাহিনী মোতায়েন করে, সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার পর ২০১৯’র ৫ আগস্ট রাজ্যসভায় ৩৭০ধারা বাতিল করার রাষ্ট্রপতির নির্দেশ পাশ করিয়ে নেয় মোদী সরকার। সেদিন রাজ্যসভায় কেন্দ্রের এই ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করে সিপিআই(এম), সিপিআই, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, আরজেডি, পিডিপি, ন্যাশনাল কনফারেন্স, এমডিএমকে। বিরোধীরা ওয়েলে নেমে এসে তুমুল বিক্ষোভ দেখান।
তৃণমূল এবং এনসিপি সরকারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সময়ে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে গিয়ে জয়ের রাস্তা আরও সরল করে দেয়।
প্রসঙ্গ: তিন তালাক
তিন তালাক বিল নিয়েও দু’মুখো, ধান্দার কৌশল নিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। যা আসলে আরএসএস, বিজেপি’র হাতই শক্ত করেছিল।
২০১৭-র ২৮ডিসেম্বর লোকসভায় পাশ হয় তিন তালাক সংক্রান্ত বিল। সেদিন সিপিআই(এম) দুটি বদল চেয়েছিল বিলে। আর তৃণমূলের সাংসদরা চুপ করে বসেছিলেন। তবে এই বিষয়ে ২০১৭-র ৫ নভেম্বর ধর্মতলায় জমিয়তে উলেমায়া হিন্দের জনসভায় হাজির হয়ে মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ট, তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিব রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি তিন তালাক রদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,‘‘জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে থাকবে কিনা, তা আমিই ঠিক করবো।’’ অর্থাৎ সঙ্কীর্ণদের খুশি করতে, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরির সভায় তৃণমূল জানিয়ে দিয়েছিল যে, তিন তালাকের পক্ষে তারা।
Comments :0