Editorial

চন্দ্রচূড়ের আত্মপরিচয়

সম্পাদকীয় বিভাগ

ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর হিন্দুত্ববাদী সত্তার পুনঃপ্রকাশ ঘটালেন। অযোধ্যার মন্দির-মসজিদ বিতর্ক এবং সেই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে যে মতামত ও ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তাতে একথা বলার জো নেই হিন্দুত্ববাদীদের ভাষা তাঁর মুখে শোনা গেছে। বলা যায় তিনি নিজেই হিন্দুত্ববাদের নয়া ভাষ্যকার হয়ে উঠেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কে কোন আদর্শে বিশ্বাস করবেন, ইতিহাস যুক্তি-বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে আবেগতাড়িত ধর্মান্ধ বিশ্বাসে বিভোর হবেন কিনা সেটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। চন্দ্রচূড়ও হিন্দুত্ববাদে আস্থাশীল ও অন্ধবিশ্বাসী হতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো কয়েক বছর আ‍‌গে তিনি দেশের বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আসনে আসীন ছিলেন। জীবনের একটা বড় সময় অতিবাহিত হয়েছে উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৯ সালে যে রায়ে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ সংলগ্ন সমস্ত জমি মন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া হয় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সংবিধান বেঞ্চ তার অন্যতম সদস্য ছিলেন চন্দ্রচূড়। সেদিনের রায়ে যে কথাগুলি সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিল আজ অবসরের পর তার থেকে কয়েক যোজন সরে গিয়ে ভিন্ন মত হাজির করেছেন। তাহলে কি ধরে নিতে হবে বিচারক হিসাবে যে রায় তিনি দিয়েছিলেন সেটার সঙ্গে তিনি সহমত ছিলেন না। ভিন্নমত থাকলে পৃথক রায় দিতেই পারতেন, দেননি। কেন দেননি গুরুতর প্রশ্ন। তার থেকেও গুরুতর প্রশ্ন অবসর নিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন কেন?
চন্দ্রচূ‍ড়ের মতে মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো ছিল মৌলিক অপরাধ যাকে তিনি মৌলিক অপবিত্রকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অযোধ্যা মামলার রায়ে কোথাও বলা হয়নি মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি হয়েছে। এমন কথাও বলা হয়নি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে আইনের কষ্টিপাথরে বিচার করে রায় দেওয়া হয়েছে। বরং ইঙ্গিত ছিল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই রায় দান করা হয়েছে। যে সব ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি এএসআই’র পক্ষ থেকে হাজির করা হয়েছিল তাতেও নিশ্চিতভাবে বলা হয়নি সেখানে অতীতে কখনোও মন্দির ছিল। এমন প্রমাণও হাজির করা যায়নি তেমন কোনও মন্দির ভাঙা হয়েছিল মসজিদ বানানোর জন্য। এএসআই এটা বলেছে দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু ঘরানার কোনও কাঠামোর অস্তিত্ব ছিল তবে সেটা মন্দির না অন্য কিছু সেটা বলতে পারেনি। সেই কাঠামো কেন, কখন, কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল বলতে পারেনি। মসজিদ নির্মাণের জন্য ভাঙা হয়েছিল কিনা সেটাও বলতে পারেনি। বরং এএসআই বলেছে দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝখানের ৪০০ বছরের ইতিহাস অজানা। অতএব মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে এমনটা নিশ্চিতভাবে বলার কোনও সুযোগ নেই। তাই রায় হয়েছে প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বিশ্বাসের ভিত্তিতে হিন্দুত্ববাদীদের অনুকূলে। সেদিন সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে তাই সঙ্গতভাবেই বলা হয়েছিল রায় দেওয়া হয়েছে বিচার হয়নি।
হিন্দুত্ববাদী বিশ্বাসের পক্ষপাতিত্বকে যতটা সম্ভব পর্দার আড়ালে রেখে সেদিনের রায়টি লিখেছিলেন চন্দ্রচূড়। আজ তিনি নিজেই সেই পর্দা সরিয়ে দিয়ে নিজের আত্মপরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রকারান্তরে সেই সংবিধানেরই মর্যাদাহানির ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন চন্দ্রচূড় মহাশয়। এটা শুধু বিচারবিভাগের মৌলিক নৈতিকতা লঙ্ঘন নয়, সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদাকেও কলঙ্কিত করা।

Comments :0

Login to leave a comment