স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে অনেক প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার পালন করেছেন কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতো এমন ভাঁওতাবাজ আর কেউ ছিল না। ভাষণে তিনি যত বড় ওস্তাদ ঠিক ততটাই ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি পূরণে। চার আনার কাজ করার যোগ্যতা নেই চৌদ্দআনা ভাষণ। তবে অন্য সব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংক্রান্ত, ব্যর্থ হলেও একটা বিষয়ে তিনি দারুণ সফল। সেটা হলো ঘৃণা-বিষ ছড়িয়ে মানুষের বিভাজন সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গতভাবে মেরুকরণ তীব্র করা। হিন্দুত্ববাদীদের এটাই একমাত্র লক্ষ্য। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই হিন্দুত্ববাদীদেরই পোস্টার বয়। নিজের সম্পর্কে বানিয়ে গল্প বলে আত্মপ্রচারের এমন দৃষ্টিকটু মানসিকতাও অতীতের কোনও প্রধানমন্ত্রীর ছিল না। তাঁর আত্মকথন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু সন্দেহজনকই নয়, হাস্যকরও হয়ে ওঠে। তেমনি তাঁর মতো বিচিত্র পোশাকবিলাসী ও সাজবিলাসী প্রধানমন্ত্রীও বিরল। তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে নিয়মিত ভাষণ দেন, জ্ঞান বিতরণ করেন কিন্তু তাঁর হিন্দুত্ববাদী আদর্শ সহযোগীদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো এবং সংখ্যালঘু ও দলিতদের ওপর হামলা ও হেনস্তা করার ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। দেখেও দেখেন না শুনেও শোনেন না। গণতন্ত্র, সংবিধান, সমানাধিকার, সম্প্রীতির কথা আওড়ান। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার সরকার ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ, গণতন্ত্রের সঙ্কোচন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ছেঁটে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার বৈচিত্রকে নির্মূল করে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান নির্মাণে দ্রুত পদচালনা করছে। সর্বোপরি হিন্দুত্বের কুয়োয় অবগাহন করে বিজ্ঞান ও যুক্তির সমুদ্রকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সবটাই নরেন্দ্র মোদীর একচ্ছত্র নেতৃত্বে।
কার্যক্ষেত্রে তিনি যত অযোগ্য ও ব্যর্থ হোন না কেন প্রতিশ্রুতিদানে এবং হামবড়াভাব প্রদর্শনে তাঁর কোনও কার্পণ্য নেই। তিনি ছোটখাট প্রতিশ্রুতি দেন না। তেমনি তাঁর লক্ষ্যপূরণের টার্গেট বা সময়সীমাও দু’চার বছরে সীমাবদ্ধ থাকে না। এক ধাক্কায় তিনি পাঁচ বছর, দশ বছর এমনকি পঁচিশ বছরের স্বপ্নপূরণের ফানুস ওড়ান। আর সেই ফানুস কিছু দূর গিয়েই ফুটো হয়ে যায়। অনেক লম্বা-চওড়া ভাষণ আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি গায়ের জোরে নোট বাতিল করেছিলেন। পরে প্রমাণ হয়ে গেছে তাঁর ঘোষিত একটা উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। বদলে মানুষের যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। তড়িঘড়ি জিএসটি-ও দেশের অর্থনীতিকে গাড্ডায় নামিয়েছে। নোট বাতিল ও জিএসটি’র ধাক্কায় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্য সংস্থার যে সর্বনাশ হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা আজও সম্ভব হয়নি। আর এই ক্ষুদ্র-ছোট ও মাঝারি ক্ষেত্র দেশের সিংহভাগ কর্মসংস্থানের ঠিকানা। আজ দেশে যে কাজের হাহাকার, সীমাহীন বেকারি তার মূলে কিন্তু মোদী সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত।
মোদী একটি অতিপ্রিয় ইভেন্ট স্বাধীনতার ৭৫ বছর। মোটামুটি পাঁচ বছর আগে থেকেই, বিশেষ করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি স্বাধীনতার ৭৫ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালকে আত্মপ্রচারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রচারের ঢেউ তোলা হয় ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতির বিস্ময়কর বিকাশের মধ্য দিয়ে ৫ লক্ষ কোটি ডলার হবে। পরে হাল বুঝে গোলপোস্ট সরিয়ে করা হয় ২০২৪ সাল। এখন দেখা যাচ্ছে ২০২৬ সালে সেটা হবে কিনা সন্দেহ। তবে এটা নিশ্চিত মোদী সরকার ক্ষমতায় না থাকলে অনেক আগেই এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো। প্রধানমন্ত্রীর গালভরা ঘোষণা ছিল ২০২২ সালের মধ্যে সব ভারতীয়’র বাড়ি তৈরি করে দেবেন। কিন্তু কাজে ল্যাজেগোবরে অবস্থায় পড়ে এখানে গোলপোস্ট দু’বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটা যে আরও পাঁচ বছর পিছাবে সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সেই ২০১৬ সালে ঘোষণা করেছিলেন ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা হবে। বাস্তবে সবটাই ভাঁওতা। সরকার এই লক্ষ্যে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি। প্রকৃত পক্ষে কৃষি ও কৃষকের সঙ্কট বেড়েছে। প্রকৃত আয় কার্যত কিছুই বাড়েনি। সব ঘরে রান্না গ্যাস দেবার কথাও বলা হয়েছিল। ঘটা করে চালু হয় উজ্জ্বলা প্রকল্প। গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় গরিব নিম্নবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্তও ঘরেও গ্যাস ব্যবহার কমে দূষণযুক্ত জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে শৌচাগার হয়নি, সব বাড়িতে বিদ্যুৎ যায়নি। মহাকাশে মানুষও পাঠানো যায়নি। এমন প্রায় ৩০টি গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েও পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী। এমন প্রধানমন্ত্রীকে অপদার্থ বলা না হলে কাকে বলা হবে?
Comments :0