বছর শেষ হতে আর ৭২ ঘন্টাও সময় নেই। বর্ষবরণের উৎসবে মেতে ওঠার তোড়জোড় শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। এবং এই সমস্তটার মধ্যে আমরা ভুলে গিয়েছি ডেডলাইন ২০২২’র কথা!
কী এই ডেডলাইন ২০২২? ২০১৩-২০১৪ সাল, অর্থাৎ দিল্লির মসনদে বসার ঠিক আগে থেকে নরেন্দ্র মোদী একাধিক প্রকল্পের ঘোষণা করে জানিয়েছিলেন, সেগুলি ২০২২ সালের মধ্যে, অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫বছরের মাথায় শেষ হবে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে ২০২২ সালের মধ্যে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর দাবি, তেমনই রয়েছে দেশের প্রতিটি নাগরিককে পাকা বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দেওয়া, প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি। ঘড়ির কাঁটা ৩১ ডিসেম্বরের রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ছোঁয়ার আগে একনজরে দেখে নেওয়া যাক প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি। একইসঙ্গে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক, নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা পালন করতে পেরেছেন বিজেপির ‘বিকাশ পুরুষ’।
প্রথমেই আসা যাক বিদ্যুৎ সংযোগের কথায়। ২০১৪ সালের ১২ জুন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের প্রথম ভাষণেই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী প্রতিশ্রুতি দেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরের মাথায়,(পড়ুন ২০২২ সালের মধ্যে) দেশের প্রতিটি বাড়িতে ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ মিলবে। ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বারাণসীর সভা থেকেও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। সেই সময় বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিলেন, বিহার নির্বাচনকে মাথায় রেখেই পূর্বাঞ্চলের মাটিতে দাঁড়িয়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছেন মোদী। যদিও বিজেপির তরফে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দাঁড়িয়ে ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে বিদ্যুতায়নের কাজ?
কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশের ৮৩.৮৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। ২০২০ সালের নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৮৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী পরিচালিত সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬ বছরে মাত্র ৩ শতাংশ বিন্দুর কিছু বেশি বিদ্যুতায়নের কাজ করতে পেরেছে প্রথম এবং দ্বিতীয় এনডিএ সরকার।
২০২০ সালের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংক্রান্ত কোনও রিপোর্ট নেই। ২০২০, ২১ এবং ২২’র কিছুটা সময় করোনার জন্য থমকে ছিল সরকারের যাবতীয় কাজ। ফলে ২০১৪-২০২০ সময়কালের গতিকে মাথায় রেখে ধরে নেওয়া যেতেই পারে দেশের বিদ্যুতায়নের চিত্র মোটের উপর একই আছে।
এবার আসা যাক নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় ‘ধামাকেদার’ প্রতিশ্রুতিতে। ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট লালকেল্লার প্রাকারে দাঁড়িয়ে মোদী সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২ সালে মহাকাশে দেশীয় প্রযুক্তিতে মানুষ পাঠাবে ভারত। ২০২২ সাল, অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫ বছর। বিজেপি এবং আরএসএস’র উগ্র জাতীয়তাবাদের ককটেলের পক্ষে আদর্শ বছর। যদিও সেখানে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বদলে শত্রু ঠাওর করা হয়েছে একইসময়ে স্বাধীন হওয়া প্রতিবেশী দেশকেই। নরেন্দ্র মোদীর সেই সময়ের ভাষণ বিশ্ব জুড়ে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কারণ এর আগে মাত্র ৩টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তির বলে মহাকাশে মানুষ পাঠাতে পেরেছে। সেদিক থেকে দেখলে সোভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিনের পরে চতুর্থ দেশ হিসেবে সেই গৌরব অর্জন করত ভারত।
সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ছবিটা ঠিক কী?
২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানান, গগনযান প্রকল্প( পড়ুন মহাকাশে মানুষ পাঠানোর প্রকল্প) পিছিয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করছে ২০২৪ সাল নাগাদ রাশিয়ার সহযোগিতায় মহাকাশে নভশ্চর পাঠাতে। এই প্রকল্পের ফিরিস্তি দিয়ে তিনি জানান, গগনযান প্রকল্পে মোট খরচ হবে ৯০২৩ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, প্রথম ভারতীয় হিসেবে রাকেশ শর্মা ১৯৮৪ সালেই মহাকাশে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু সেটি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায়। গগনযান প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের মাটি থেকে ভারতীয় প্রযুক্তিতে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় নরেন্দ্র মোদী সরকার। তারজন্য বেছে নেওয়া হয় স্বাধীনতার ৭৫তম বছরকে।
যদিও ২০২৪ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, ইউক্রেন সংঘাতের ফলে রাশিয়ার উপর পশ্চিমী বিশ্ব একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা না উঠলে রাশিয়ার পক্ষে খোলাখুলি ভাবে মহাকাশ প্রযুক্তি ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া সম্ভব নয়। এবং ইউক্রেন যুদ্ধ আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে মিটবে এমন কোনও আভাসও এখনও পর্যন্ত মেলেনি। সবমিলিয়ে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর দ্বিতীয় ডেডলাইন ‘মিস’ হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
(চলবে)
Comments :0