এবারও কৃষকরা সরকারি দামে ধান বিক্রি করতে পারলো না। তাদের কার্ড নিয়ে গেল ফড়িয়ারা । অন লাইনে স্লিপ তুললো তারাই। মাণ্ডিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলো ঐ ফড়িয়াই। কৃষকের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে ঐ ধান বিক্রি বাবদ যে টাকা, তা তুলে নিয়ে এল সেই কৃষককে সঙ্গে করে সেই ফড়িয়াই। চাষির হাতে দিল কয়েকশো টাকা।
ধান বিক্রি করতে গেলে কার্ড দিয়ে অন লাইনে টোকেন বা স্লিপ বের করো, সেই স্লিপ মান্ডিতে জমা দাও, বেশ কিছুদিন পরে ধান কেনার ডেট পড়বে। তারপর অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে। তাও বেশিরভাগ সময় অনেকদিন পরে।
অত হ্যাপা গরিব-মাঝারি চাষিবাসি মানুষের পক্ষে সামলানো সম্ভবও নয়। তাই বেশিরভাগ চাষি গাঁ-গঞ্জের আড়তদারের কাছেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। এবং ব্যাপক ঠকছেন।
গমের বীজ কিনতে গিয়ে আমার বন্ধু খলিলের অভিজ্ঞতা এরকম— পাড়ায় সামাঞ্জুর কাছে শুনে এসেছিলাম, এবার বীজের অনেক দাম, ১৭০০ টাকা করে ৪০ কিলোর বস্তা। আমিও সেই হিসাবে টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম।
আজ ফুলবাড়ি বাজারে গেলে দোকানদার বলল ১৮৫০ টাকা বস্তা! হায় বাপ! একদিনে বেড়ে গেল বস্তা পিছু ১৫০ টাকা। তাও আজ পাবো না, পাবো কাল সকালে। এদিকে কাল সকালে আমার জমিতে ট্রাকটর নামবে। তা হলে কী করা যায়! চলো গঙ্গারামপুর, দেখি।
গঙ্গারামপুরে অনেক দোকান। প্রথমে এক বড় দোকানে গিয়ে বলতেই একটা অর্ধেক বস্তা দেখিয়ে বলল, বীজ এই এইটুকুই আছে। বুঝলাম, আরও বেশি দাম পাবার ব্যবস্থা করে সব বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আরেক দোকানি বলল– ১ কুইন্টাল মতো হবে। দাম? ১৮৬০ টাকা বস্তা। আরও দু’-একটা দোকান ঘুরে, বাড়ি ফিরে আসবার পথে কালদিঘির এক দোকানে এলাম। না, এখানেও নেই। বাপ-ব্যাটা ব্যস্ত আলাপে। কী আলাপ! বাপ হেসে হেসে বলছে ব্যাটাকে, তোর সঙ্গে এডিও সাহেব কথা বলবে বলে ফোন করেছিল। বুঝলাম গম বীজের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে কৃষি অফিসাররা আছেন।
ফেরার পথেই একটু এগিয়ে গচিয়ার বাজার। ছোট দোকান। দোকানের মালিক আমার পরিচিত। তার ছেলে বসেছিল। বলল, আধঘণ্টা বসতে হবে। বলে কাউকে ফোন করলো – এই, আমার দোকানে তাড়াতাড়ি কয়েক বস্তা বীজ পাঠাতো!-কত দাম পড়বে? সে বলল, বীজ আসুক, তবে ১৮০০ টাকার কম নয়। সেখান থেকে ১৮০০ টাকা বস্তা দরে ৯ হাজার টাকা দিয়ে ২ কুইন্টাল বীজ নিয়ে এলাম। মনে হলো গচিয়ারের ছোট দোকানদার অত সেয়ানা হয়নি। ছোট দোকান তো বোধহয় সে জন্য।
গণশক্তিতে মাসখানেক আগের লেখায় দেখিয়েছিলাম, কী রকম সারের সঙ্কট চলছে এবার! ৫০ কিলোর সুফলার বস্তার গায়ে লেখা ১৫৬০টাকা। চাষি তাও ১৭০০ টাকা দিয়ে কিনছিলেন। হঠাৎ হয়ে গেল ২৫০০ টাকা। এখন গম আর সর্ষে বোনার হুড়োহুড়ির সময় তা বেড়ে হয়েছে ২৬০০ টাকা।
কয়েক দিন সরকারি লোকজন, মিছিল-ডেপুটেশনের চাপে একটু নড়া-চড়া করলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না। সরকারের ইচ্ছা থাকলে তো হবে কিছু! সরকার ও অফিসারদের সহযোগেই তো এই কৃত্রিম সঙ্কট। এই কালোবাজারি।
এতো খরচ করে চাষ করে যে কী হবে! খলিল বলল– সব উপরআলার ভরসা। জমিন তো ফেলাই রাখা যাবি না!
দেনার দায়ে ভাতার থানার রাধানগরের আত্মঘাতী মহফুজ আলী শাহ নামে এক চাষির কথা গণশক্তিতে পড়েছে। সে ঘটনা শোনালো।
এবার আমাদের দক্ষিণ দিনাজপুরে ধানের গড় উৎপাদন খারাপ নয়। কিন্তু রাজ্যের সব জায়গায় তো তা নয়। অনাহার–অর্ধাহার অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করছেন অনেকে।
কয়েকজন মিলে যে গল্প মন্টুর দোকানে বসে করছিলাম তার শেষ কথাটা এরকম— কী সরকার আলি রে ভাই- শুধু চুরি চুরি আর চুরি। ব্যাটাদের গাও থাকি পচা গন্ধ ভেড়াছে।
দুই
আমাদের অনেকের ধারণা, বামফ্রন্ট সরকার যে ব্যবস্থাদি নিয়েছিল, তার সুফলের রেশ অনেক দিন থাকবে এবং অনাহার– আকালের দিন বিগত হয়ে গিয়েছে। তা যে ঠিক নয়, সেটা চাক্ষুষ গিয়ে দেখলাম মালাহার নামে একটা গ্রামে। এসসি সম্প্রদায়ের কোলকামারদের বড় একটা পাড়া। সেই পাড়ায় আমার গ্রাম সম্পর্কে এক নাতির বিয়ে হয়েছিল, সেই বউ স্বামী-শ্বশুরের ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি ফেরত আনা যায়, সেজন্য এ পাড়ার একটা বাড়িতে আমাদের যাওয়া। ঐ বাড়িতেই আলাপ হচ্ছিল এক মধ্যবয়স্কা নারীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, এই পাড়ায় কোনও জোয়ান ছেলে নাই বাবা! সব বিদেশে খাটতে গিয়েছে। বুড়োরা আর আমরা মেয়েমানুষরা আর বাচ্চাগুলো পড়ে আছি। ধান রোয়ার সময় মেশিন দিয়ে জমি তৈরি করলেও, আমাদের বৌ বেটিদের রোয়ার কাজটা মিলতো। এখন ধান কাটার সময় এমন মেশিন আসছে, আমাদের মেয়ে মানুষের কোনও কাজ নাই। কাজ নাই তো পয়সা নাই। পয়সা নাই তো খাওয়া নাই। আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, সত্যি! জবাব পাই – হ্যাঁ বাবা, সত্যি সত্যি। আমদের এই বাড়ির, তোমার নাতির বৌয়ের দিদিকে ওর স্বামী ছেড়ে চলে গিয়েছে। ও নারইতে চটকলে ১২ঘণ্টা ডিউটি করে যা পায়, তা দিয়ে ওর ব্যাটা, বুড়া রোগা বিছানায়-থাকা বাপ, ওর বহিন– তোমার নাতিবৌ, তার ছোট্ট ব্যাটাকোনা, আমি -এতো গুলা মানুষের পেট চলে। তা কি চলতে পারে, বলো বাবা! তাই মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকতে হয়।
আমি মনে মনে ভাবি- আকাল তবে চলেই এল!
জানা গেল– এ পাড়ার মার্ক টু খারাপ। জল বেরোয় না। বার বার বলেও মেরামত হয়নি। সাধারণ টিউবয়েলটা কয়েকদিন আগে বসলো। কাজের মান এতো খারাপ যে, জল বেরোয় না। আমি মনে ভাবি অন্ন কষ্ট জল কষ্ট মিলে তো এদের মতো আরও কত পাড়ার মানুষের না নাস্তানাবুদ অবস্থা!
ঘর পেতে অগ্রিম ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। তাই এ পাড়ার কেউ ঘর পায়নি– তাও জানলাম।
একটু পরে সুশীলের বিধবা বৌ এল। ও বিধবা ভাতা পায়নি– জানালো।
বাড়িতে ফিরে এসেই শুনি, বাঁশপাড়ার বুধুর ব্যাটা রবিনাথ উঁরাও, ভিনরাজ্যে কাজ করতো, বয়স মাত্র ২১ বছর, ওর লাশ আজ এসেছে কাজের জায়গা থেকে। ছেলেটা হায়ার সেকেন্ডারি পাস ছিল। এখানে কোনও গতি হলো না। চলে গেল দিল্লি। এবং মরেও গেল ব্যারামে।
দিঘিপাড়ার দেবু-দেবুর বৌ, ওর ব্যাটা তিন জনেই গিয়েছিল দমনে। ঐ পাড়ার আরও ২০-২৫ জন গোয়া আর দমনে কাজে গিয়েছে। দেবুর বউয়ের কী যে অসুখ ধরলো, কিডনিদুটোই নষ্ট হয়ে গেল। ওরা ফিরে এল। দেবু সাধ্যমতো ওর চিকিৎসা করালো, কিন্তু বাঁচলো না। বৌটার নাম রত্না । বয়স মাত্র ৪২ বছর। বাঁশপাড়ায় সত্যনাথ ও দিঘিপাড়ায় রত্নার একই দিনে শ্রাদ্ধ হলো।
তিন
চালুনের এক গ্রামে এক রাগী সাথি বলছিল – আচ্ছা কাকু, লক্ষীর ভাণ্ডারের টাকা প্রফেসারের বউ, হেডমাস্টারের মা কেন পাবে? স্বাস্থ্যসাথী কার্ড কেন সবাই পাবে? তৃণমূলের রাজত্বে এক বড়লোক বাড়ির স্বামী –স্ত্রী দু’জনেই বার্ধক্য ভাতা পায়। ও নাম বলল। অথচ কাকু, ওরা ওদের ব্যাটার বিয়ে দিল ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করে।
আর এই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা টাকা নিয়ে তো নয়-ছয় হবেই; দিল্লি জানতো না! তাই তো হচ্ছে, তার লিস্ট করার সময়। আবার নাকি একশো দিনের কাজের টাকাও পাঠাবে।
রথীন বললো – তোর সব কথা ফেলে দেওয়া যাবে না। তবে কেন্দ্রের টাকা তো কারও বাপের টাকা নয়! তাই দিতেই হবে।
- কিন্তু ঐ টাকা মেরে তো তৃণমূল ভোট ডাকাতি করবে!
- তাতে বিজেপি’র কী ক্ষতি হবে! ক্ষতি হবে বামেদের! বামেদের ক্ষতি হোক বিজেপিও চায়, তৃণমূলও চায়।
- তাহলে কী করবে?
- লড়াই চলছে চুরি ডাকাতি লুটের বিরুদ্ধে, তার মাত্রা অনেক বাড়াতে হবে।
তখন ঐ কাজিপাড়ার আড্ডায় অনেক কথা এল। আমাদের এলাকার নেতা রবিউল ছিল। সে বিজেপি – তৃণমূলের মিল মহব্বতের কথা বেশ খুলে বলল। সে বোঝালো এই দুই দল মানুষগুলোকে কেমন ভিখারি বানিয়ে দিল। মমতার দান দক্ষিণার উৎসবে যেমন মানুষ পায়ের তলায় পড়ে মারা গিয়েছিল, তেমনই, শুভেন্দুর কম্বল বিলির উৎসবেও মারা গেছে গরিব মানুষ!
আমি নবীন যুবককে বললাম, তোদের বেকারদের তো কঠিন অবস্থা! তোরা কী করবি?
- মাস্টারিতে যা সব কেচ্ছাকাহিনি, চুরি– কী যে হবে!
আমি বলি– অত হতাশ হস না বাবা।
সে বলল – হতাশ হইনি। লড়াইয়ের ডাকে যাচ্ছিও। কিন্তু এই পাপের রাজত্ব শেষ না হলে আমাদের কাজ কর্ম কিছুই হবে না।
চার
সে’দিন গিয়েছিলাম বংশীহারি থানার একটা গঞ্জে। সেখানে এক জেলা যুব নেতার বাড়ি। আমাদের মধ্যে কাকা-ভাতিজার সম্পর্ক। নামটা সঙ্গতকারণেই এখানে বলছি না। ওর বাড়িতেই দুপুরের খাওয়া।
ওকে জেলার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়।
জিজ্ঞেস করি- খবরাখবর কীরকম রে বাবা!
ও খুব সুন্দর করে কথা বলে। এবং বলে ছেদহীনভাবে।
ওর কথায় যা জানা গেল– এতোদিন যে মানুষ আমাদের কথা বিশ্বাস করছিল না বামেরা জিততে পারে, ইদানীং পরিস্থিতি পালটানোয় তারা চিন্তা করছে। তৃণমূলের মধ্যে গোলমাল ভালোই। এক পঞ্চায়েত সমিতির মেম্বার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে – মোক দাঁড়াবা না দিলে পোখর বাহিন করি দিম।
তৃণমূল–বিজেপি’র লোক দেখানো খেয়োখেয়ি মানুষ অনেকটাই বুঝে গিয়েছে।
মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তা, মানে বামেদের দিকে চিন্তাটা ঘুরছে। কেউ কেউ পার্টির লোকদের বলছে - একনা জোর দি খাটো। একনা চারি ওঠো।
তৃণমূলের কেউ বলছে– হামরা যারা একসাথে সিপিএম ছাড়ি গেইচেনো, তারা একে সঙ্গে আবার ঘুরি আইসমো।
অনেক মিটিং চলছে। সারা রাজ্যব্যাপী যে লড়াই চলছে, তা লাগাতার ধরনেরই বলা যায়। জাহান্দারের কথায় – একই গিয়ারে পার্টিটা চলছেলো, এখন একনা উপর গিয়ারে গেইচে। কিন্তু একদম টপ গিয়ারে গাড়ি চালাবা হবি বো কাকা। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক গতিশীলতাকে অনেক বাড়াতে হবে। মানুষ আমাদের কথা অনেক বেশি শুনতে চায়, আমাদের সঙ্গ অনেক বেশি পেতে যায়। আমরা মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের মতো শ্রম দিচ্ছি না। তাই এখন থেকেই গ্রামে গ্রামে সকল কমরেডদের পড়ে থেকে কাজ করা দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে এসে গিয়েছে।
বেশি করে মানুষ লগ্ন হয়ে থাকতে পারলে, পুরানো অভ্যাস যেমন, গ্রামে যাওয়া, বৈঠকিসভা করা, মানুষের সুখ-দুঃখের একটু সাথি হওয়া– এসবকে ফিরিয়ে আনতে পারলে আমরা অপ্রতিরোধ্য। কোনও রাজনৈতিক মূঢ়তা বাংলাকে আর গ্রাস করতে পারবে না।
Comments :0