Post editorial

অভয়া আন্দোলন দ্বিতীয় তরঙ্গে প্রতিরোধের ডিঙ্গা ভাসাও

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী

‘আর জি কর করে দেব!’ এরাজ্যের শাসকঘনিষ্ঠ সমাজবিরোধীদের মুখে হুমকির এই নতুন লব্জ জুগিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। ৯ আগস্টের পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরতা মহিলা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঠিক এই ভাষায় শাসানো হয়েছে। ‘‘আর জি কর করে দেব’’ এই শাসানির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আর জি কর হাসপাতালের ৯ আগস্টের ঘটনা কেন ব্যতিক্রমী তার উত্তর। ‘আর জি কর করে দেব’ - এই হুমকির অর্থ শুধু ধর্ষণ করে খুন করে দেব, তা নয়। এর অর্থ হলো ধর্ষণ ও খুন করে পুলিশের সাহায্য নিয়ে এমনভাবে তথ্য-প্রমাণ লোপাট করে দেব, কেন্দ্রের শাসক ও রাজ্যের শাসকের সেটিংয়ে এমনভাবে তদন্তের নামে নাটক করাবো, যাতে প্রকৃত অপরাধীদের কোনোভাবেই ধরা না যায়!

প্রথম থেকেই অভিযোগ ছিল যে আর জি কর হাসপাতালের এই নৃশংস ঘটনা এক পরিকল্পিত, দলবদ্ধ অপরাধ। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও তার ইঙ্গিত ছিল। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির (সিএফএসএল) রিপোর্ট, যার মধ্যে ডিএনএ অ্যানালিসিস রিপোর্টও রয়েছে, এবং মাল্টি-ইন্সটিটিউশনাল মেডিক্যাল বোর্ডের (এমআইএমবি) অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট। রিপোর্টগুলি এই ব্যতিক্রমী খুন-ধর্ষণের প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রকে ফাঁস করে দিয়েছে আরও স্পষ্ট করে।

সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুসারে নির্যাতিতা মেয়েটির শরীরে যতগুলি, যে ধরণের চোট-আঘাত ছিল, যেভাবে মেয়েটি শায়িত ছিল, নমুনা যা সংগৃহীত হয়েছে, তা থেকেই খুনের আগে দলবদ্ধ নৃশংস অত্যাচার ও ধর্ষণের ইঙ্গিত ছিলই। এমআইএমবি রিপোর্ট বলছে মোট ষোলটি চোট-আঘাতের মধ্যে অন্তত ছ’টি আঘাত হয়েছে নির্যাতিতা মেয়েটি ধর্ষক ও খুনিদের বাধা দেবার সময় ধস্তাধস্তির ফলে। গ্রেপ্তারের অব্যবহিত পরে সঞ্জয় রায়ের যে মেডিক্যাল ইনজুরি রিপোর্ট করানো হয়, সেখানেও নির্যাতিতার সঙ্গে তার সংঘাত ও ধস্তাধস্তির চিহ্নস্বরূপ চোট-আঘাত রয়েছে। অন্যদিকে, সিএফএসএল রিপোর্টে উঠে এল যে চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার হলে ধর্ষক ও খুনিদের সঙ্গে নির্যাতিতার সংঘাতের কোনও চিহ্ন মেলেনি। মৃতদেহের আশেপাশে থাকা আসবাবপত্র একটুও এদিক-ওদিক হয়নি, সেমিনার হলের ডায়াসের পাটাতনে কোনও রক্তের দাগ নেই, ম্যাট্রেসের উপরেও তেমন কিছুই নেই। কোলকাতা পুলিশের তোলা অকুস্থলের চল্লিশটি ছবির মধ্যে প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে টানটান করে পাতা ম্যাট্রেসে শায়িত মৃতদেহের পাশে নির্যাতিতার ল্যাপটপ, তার উপর একটি নোটবুক এবং তার উপর রাখা তার মোবাইল ফোন গুছিয়ে রাখা আছে। এমনকি, তার চপ্পলজোড়াও পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে রয়েছে। অথচ এধরণের অপরাধের অকুস্থল কখনোই এরকম ড্রইং রুমের মতো পরিপাটি করে সাজানো হতে পারে না।

যদি কষ্ট করে কল্পনাও করা যায় যে অপরাধী একজনই ছিল, তাহলেও ধস্তাধস্তি, প্রতিরোধের চিহ্ন তো থাকবেই। এমন হতে পারে না যে অপরাধী এক হাতে মেয়েটির গলা চেপে অন্য হাতে তাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করেছে। কেন না মেয়েটির পরনে ছিল জিনস প্যান্ট, যা খুলতে ধর্ষককে দুই হাত একসাথে ব্যবহার করতেই হয়েছে আর সেসময় মেয়েটি প্রাণপণে বাধা দিয়েছে অবশ্যই। আশেপাশে সেই বাধার চিহ্ন ছড়িয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

সেমিনার হলের একমাত্র প্রবেশপথে কোনও সিসিটিভি কভারেজ ছিল না। অন্য একটি সিসিটিভি-র ফুটেজে ধৃত সঞ্জয় রায়কে ৯ আগস্ট ভোরে সেমিনার হলের দিকে যাবার করিডরে ঢুকতে ও কিছুক্ষণ বাদে বেরোতে দেখা গেছে। আদালতে সঞ্জয় বয়ান দিয়েছে যে সে আর জি কর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ধূমপান করে তারপর হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়েছে। অথচ লিফট থেকে নামার ঠিক তেতাল্লিশ সেকেন্ডের মাথায় শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পেরতে দেখা গেছে তাকে। যদি ধূমপান না করেও সঞ্জয় বাইক অবদি হেঁটে এসে বাইক স্টার্ট দিয়ে শ্যামবাজার যায় ও সবক'টা সিগন্যাল গ্রিন পায়, তবুও এত কম সময়ে এই ছ'শো মিটার রাস্তা পেরনো একেবারেই অসম্ভব, ধূমপান করার পর বাইক স্টার্ট করলে আরোই অসম্ভব। ফলে আর জি কর হাসপাতালের ঐ রাতের সিসিটিভি ফুটেজ বিকৃত করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই সন্দেহ আগেই ছিল, কেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনার তিনদিন পর সিসিটিভি ফুটেজ হস্তান্তর করেছে। তাছাড়া, চেস্ট ডিপার্টমেন্টের ঐ সেমিনার রুমে যাবার অন্য আরেকটি রাস্তাও রয়েছে পিছনের দিকে, যেখানে অন্য একটি লিফট ব্যবহার করে পৌঁছানো যায়। ঐ লিফট ও ঐ রাস্তাটি সিসিটিভি-র আওতার বাইরে। ফলে অন্যত্র অপরাধটি সঙ্ঘটিত করে মৃতদেহ ঐ পথে সেমিনার রুমে এনে সাজিয়ে রাখা সম্ভব।

প্রসঙ্গত, সঞ্জয় রায় গত সপ্তাহে আদালতে বিচারকের সামনে তার বয়ান দিয়েছে যে তাকে ঐ রাতে আর জি কর পুলিশ ফাঁড়ির এক এএসআই ফোন করে ডেকেছিল, ১০ তারিখ লালবাজারে তাকে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছিল ও বলপূর্বক মিথ্যে বয়ানে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল।

সিএফএসএল রিপোর্টে আরও যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি উঠে এসেছে, তা হলো -
১) ময়নাতদন্তের রিপোর্টে যোনির মধ্যে সাদা, থকথকে, চ্যাটচেটে তরল সহ ১৫১ গ্রাম ওজনের যে নমুনা সংগ্রহের কথা লেখা আছে, তা বীর্য নয়। তাহলে ঐ তরল আসলে কী, তার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস রিপোর্ট এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
২) নির্যাতিতার স্তনবৃন্ত থেকে ধৃত সঞ্জয় রায়ের লালারস পাওয়া গেছে। অথচ কোলকাতা পুলিশের তোলা প্রথম ছবিটিতে নির্যাতিতার স্তন অনাবৃত ছিল না। ধর্ষক ধর্ষণের পর স্তনবৃন্তে লালারসের নমুনা রেখে তা আবার আবৃত করে রেখে গেছে, তা কষ্টকল্পনা।
৩) নির্যাতিতার যোনি ও মলদ্বার থেকে সংগৃহীত সোয়াবে তার নিজের ডিএনএ ছাড়াও আরও একাধিক জনের ডিএনএ পাওয়া গেছে বলে নমুনাগুলিকে দূষিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে দেখলে দু’টি সম্ভাবনা - ক) যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন, অসাবধানতাবশত তাঁদের ডিএনএ মিশে গেছে নমুনায়। তা হয়েছে কিনা বোঝার সহজ ও একমাত্র উপায় হলো নমুনা সংগ্রহক দলের সকলের ডিএনএ পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখা। খ) অপরাধী একজন নয়, একাধিক। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব অপরাধী, অর্থাৎ ঘটনার রাতে ঐ বিল্ডিংয়ে যারা ছিল তাদের ও ঘটনার পর সেমিনার হলে যেসব বহিরাগতদের উপস্থিতি ছিল তাদের প্রত্যেকের ডিএনএ পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখা। যে কোনও তদন্তকারী সংস্থা আসল অপরাধীদের সনাক্ত করতে চাইলে এটাই করত। কিন্তু সিবিআই তা করেনি। অথচ সিএফএসএল ও এমআইএমবি রিপোর্ট এসেছে সিবিআই-র প্রথম চার্জশিট জমা দেবার ঢের আগে। তাদের প্রথম চার্জশিট আসলে তদন্তের নামে কোলকাতা পুলিশের নাটকে শিলমোহর।

৯ আগস্টের নৃশংস খুন-ধর্ষণের ঘটনা রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অনেকগুলি অপরাধের খতিয়ান একসাথে তুলে এনেছে - সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, অবাধ নারী নির্যাতন, অপরাধী-বান্ধব ও দলদাস প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মেডিক্যাল শিক্ষাকেও ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া, স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশা এবং হুমকির সংস্কৃতি ও ভয়ের রাজনীতি। কিন্তু লুটের টাকার জোরে ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সমীকরণে উপনির্বাচনে ছ’টি আসনে জয়কে শাসকপক্ষ এই সবকটি অপরাধের ন্যায্যতা প্রতিপাদন হিসাবে দেখাতে চাইছিল। সেই লক্ষ্যে তারা একের পর এক বার্তা দিয়েছে তাদের দলের কর্মীদেরকে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দিতে তারা সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সিবিআই-র চার্জশিট আদালতে পেশের অনুমোদন দেয়নি। রাজ্যে অবাধ নারী নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকলেও রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ মন্ত্রীর মুখে তা নিয়ে টুঁ শব্দটি অবদি নেই। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থেকে সর্বোচ্চ আদালতে মিথ্যে হলফনামা দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। অপরাধী-বান্ধব ও দলদাস প্রশাসনকে রক্ষা করতে অভিযুক্ত আইপিএস ও আইএএস অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তটুকুও শুরু না করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাঁড়ির হাল ঢাকতে জনগণের করের টাকায় কর্পোরেটের ব্যবসা বাড়ানোর স্কিম স্বাস্থ্যসাথীকে ঢাল করছে শাসক। মেডিক্যাল শিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা মসৃণ করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মেডিক্যাল শিক্ষা অধিকর্তা দু’টি পদই এখনও খালি রেখে দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে হুমকির সংস্কৃতির পান্ডাদের মেডিক্যাল কাউন্সিলে পুনর্বহাল করেছে। নারী নির্যাতনকে ন্যায্যতা দিতে আরজিকরকাণ্ডের প্রতিবাদে পদত্যাগ করা রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকারের শূণ্যস্থান পূরণ করতে শাসক বেছে নিয়েছে নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত একজনকে।

অপরাধীদের আড়াল করেই ক্ষান্ত থাকেনি শাসক, ভোট লুটের সঙ্গে যুক্ত সমাজবিরোধীদের অবাধে অপরাধ চালিয়ে যাবার বার্তা দিতে নবান্ন থেকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তাকে অভিযুক্ত বলা যাবে না এবং থ্রেট কালচারের পান্ডা দুষ্কৃতীদের নাম উচ্চারণ করার দুঃসাহস দেখানো যাবে না। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর নবান্ন থেকে রাজ্যের নার্সিংহোম ও হাসপাতালগুলির উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে গ্রেপ্তারি এড়াতে কোনও অপরাধী অসুস্থতার ভান করে এলে তাকে ভর্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক, অন্যথায় তাদেরকে প্রশাসনিক ভাবে হয়রান করা হবে।

পাশাপাশি প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ রাখতে তাদের উপর বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ণ নামিয়ে আনা হয়েছে। আর জি করকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে সরব হওয়া চিকিৎসক ও নাগরিকদের সমন পাঠিয়ে লালবাজারে ডেকে হয়রান করা, বারাসতে প্রতিবাদী শিল্পীদের পুলিশি ধরপাকড়, নৈহাটিতে মহিলা প্রতিবাদীদের দলবদ্ধ শ্লীলতাহানি, মাথাভাঙায় মন্ত্রী উদয়ন গুহের উপস্থিতিতে তার দলবলের প্রতিবাদীদের উপর চড়াও হওয়া, গড়ফার তরুণী ছাত্রী রূপসা মণ্ডলকে সমাজমাধ্যমে লেখার জন্য জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার, যুবনেতা কলতান দাশগুপ্তকে সাতদিন আটক রাখা, দক্ষিণ কোলকাতার এক পুজো মণ্ডপের সামনের রাস্তায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দেবার ‘অপরাধে’ ন’জন ছাত্র-যুবকে গ্রেপ্তার, বেহালায় রাত দখলের ডাক দেওয়া মহিলাদের থানায় ডেকে হেনস্তা, নানা জায়গায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা বেআইনি ভাবে প্রয়োগ করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী মিছিলে বাধাসৃষ্টি, জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনস্থলে পানীয় জল, খাটিয়া, বায়ো-টয়লেট ঢুকতে না দিয়ে অমানবিক আচরণ, মেডিক্যাল কাউন্সিলের সামনে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মাথার উপর ছাউনি টাঙাতে না দেওয়া, দ্রোহের কার্নিভ্যাল থেকে ধর্মতলার অভয়া মঞ্চের প্রতিবাদী গণজমায়েতে বাধা - তালিকা দীর্ঘ। সঙ্গে দোসর প্রতিবাদী চিকিৎসক ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়কদের বিষোদ্গার।

এত কিছুর পরেও জনতার প্রতিবাদ আন্দোলনকে এতটুকুও দমানো যায়নি। সরকার যত দাঁত-নখ বের করেছে, সুবিচার ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ের তেজ তত বেড়েছে। দু’জন চিকিৎসককে সমন পাঠালে কয়েক হাজার চিকিৎসক সোচ্চারে মিছিল করে লালবাজার অভিযান করেছেন, ন’জন প্রতিবাদীকে রাস্তায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান তোলার ’অপরাধে’ পুলিশ গ্রেফতার করলে পরের দিন দেড় লক্ষ মানুষ ধর্মতলায় দ্রোহের কার্নিভাল করেছেন, উত্তরবঙ্গে মন্ত্রীর দলবল প্রতিবাদীদের চারটে মোমবাতিতে জল ঢেলে দিলে দক্ষিণবঙ্গে হাজার হাজার মানুষ চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে মশাল মিছিলে পা মিলিয়েছেন। শাসক যখন সারা রাজ্যের সমস্ত সমাজবিরোধীদের এক ছাতার তলায় সংগঠিত করতে চাইছে, তখন জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা স্থানীয় প্রতিবাদী নাগরিকদের মঞ্চগুলি চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের সঙ্গে মিলে ‘অভয়া মঞ্চ’ তৈরী করে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। আক্রমণ যতই তীব্র হচ্ছে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ততই জোরালো হচ্ছে। পুলিশের অসহযোগিতা সত্ত্বেও আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে এসে দশদিন ধরে প্রতিবাদী গণজমায়েত চলছে ধর্মতলায়। ৩১ ডিসেম্বর, বর্ষশেষের রাতে সারারাত দ্রোহের অগ্ন্যুৎপাতের ডাক দিয়েছে অভয়া মঞ্চ। কেন্দ্রীয় জমায়েত ধর্মতলা মেট্রো চ্যানেলের ধরনামঞ্চে। এছাড়াও রাজ্যের নানা জায়গায় সুবিচারের দাবীতে এই কর্মসূচি পালিত হবে। নতুন বছরের শুরুতেই এই আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে আবার।
কেন্দ্র-রাজ্য বোঝাপড়ায়, দুই শাসকের যোগসাজশে এরাজ্যে গত এক দশকে ঘটে চলা অনাচারগুলি বিচারের আলো দেখতে পায় না। দেশের বিচারব্যবস্থাও এভাবে মুষ্টিমেয় প্রভাবশালীদের স্বার্থ বাঁচিয়ে চলার প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ালে গণআন্দোলনকে তীব্রতর করা ব্যতীত নির্যাতিত মানুষের সামনে আর কোনও বিকল্প থাকে না। অভয়ার সুবিচার সহ এরাজ্যে ঘটে চলা সীমাহীন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, অবাধ নারীনিগ্রহ ও প্রান্তিক যৌন-লিঙ্গতার মানুষের উপর অত্যাচার, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীর নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রসাতলে পাঠানো, প্রশাসনকে অপরাধী-বান্ধব ও দলদাস হিসেবে চালিত করা ও রাজ্যের প্রতিটি কোণায় হুমকির সংস্কৃতি, ভয় দেখানোর রাজনীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবী মানুষের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সুবিচার ছিনিয়ে আনার একমাত্র রাস্তা। অভয়া আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে রাজ্যের প্রতিটি জেলায়। এই আন্দোলনকে তীব্রতর ও তীক্ষ্ণতর করে ছড়িয়ে দিতে হবে রাজপথ থেকে আলপথে। প্রতিবাদকে প্রতিরোধের স্তরে উন্নীত করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment