এবার ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোর শিরদাঁড়ায় আঘাত করল ইরান। মঙ্গলবার তেল আভিভে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইরান। মোসাদকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আখ্যা দিয়ে, ইরানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ‘‘তেহরান হামলার পিছনে এদেরই হাত রয়েছে। এবার বুঝুক ঠেলা!’’ ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থার সদর দপ্তরে দেখা গেল আগুন জ্বলছে। এই বহুতল বাড়ির বেশ খানিকটা অংশে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ইজরায়েলী সেনা ও মোসাদের একাধিক কর্তা হামলায় নিহত হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। ইজরায়েল মুখে কিছু স্বীকার না করলেও, এই হামলায় যে বড় প্রভাব পড়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। নড়েচড়ে বসেছে আমেরিকাও। দিন দুয়েক আগে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সংঘর্ষ বিরতির পক্ষে সওয়াল করলেও, মঙ্গলবার একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পন্’ দাবি করেছে তিনি। এছাড়াও তিনি বলেন, আমরা জানি ইরানের রাষ্ট্রপ্রধান আয়তোল্লা খামেইনি কোথায় লুকিয়ে আছেন, আপাতত আমরা ওঁকে মারব না! ট্রাম্পের এমন একের পর এক তর্জনীতে ইরান ইজরায়েলের এই সংঘাত আরও গুরুতর আকার ধারণ করে পুরোদস্তুর যুদ্ধের দিকে এগতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল।
এদিকে ইজরায়েলের আরও বিভিন্ন শহরে এদিন বিক্ষিপ্ত হামলা চালিয়েছে ইরান। লাগাতার হামলায় ইজরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবারের হামলায় তেল আভিভে ১০ জন আহত হয়েছেন। এরই মধ্যে ইজরায়েলের সমস্ত বড় শহরের বাসিন্দারা হয় গ্রামের দিকে সরে পড়েছেন, কিংবা লেবানন সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। এদিনই ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে ইজরায়েল বিমান হানা চালানোর চেষ্টা করে। তবে পালটা হামলায় ইজরায়েলের অন্তত ২৮টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা হয়েছে বলে ইরানের সেনাবাহিনী দাবি করে।  
উলটোদিকে মঙ্গলবার ইরানের রাজধানী তেহরান ও ইসফাহানের একাধিক আবাসিক অঞ্চলে ইজরায়েল হামলা চালিয়েছে। ভোরে তাব্রিজ শহরের এক বায়ুসেনা ঘাঁটিতেও ইজরায়েল হামলা চালায়। তেহরানের হামলায় ইরানের সেনা কর্তা আলি শাদমানি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যম এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের কাশান শহরে ইজরায়েলের হামলায় ৩ জন নিহত হয়েছেন।
ইরানের বিভিন্ন পরমাণু কেন্দ্রে ইজরায়েলের লাগাতার হামলায় ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান জানিয়ে মঙ্গলবার এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে পরমাণু গবেষণার আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি’ (আএইএ)। উপগ্রহ চিত্র দেখে করা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই সংস্থার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ কক্ষ সহ যাবতীয় অংশে ইজরায়েলের হামলায় গুরুতর ক্ষতি হয়েছে। ইউরেনিয়াম সহ অন্যান্য তেজস্ক্রিয় ধাতুর শোধনাগারেও ক্ষতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। তবে ইসফাহান ও ফোরদৌ পরমাণু কেন্দ্রে ইজরায়েলের হামলা তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে আএইএ। এই ঘোষণায় বিশ্লেষকদের একাংশের কপালে ভাঁজ পড়েছে। এই দুটি কেন্দ্র ইরানের ‘পরমাণু গবেষণার প্রাণকেন্দ্র’ বলে পরিচিত ছিল। শুক্রবার ভোরের হামলায় তা ধ্বংস হয়েছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ইজরায়েল। তবে আএইএ’র আপাত নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ বলছে, এই দুই কেন্দ্রেই তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। 
এরই মধ্যে মঙ্গলবার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের রাজধানী তেহরানের সমস্ত বাসিন্দাকে অবিলম্বে শহর ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। এই বার্তায় আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক ছড়িয়েছে। ইরান যুদ্ধে আমেরিকা সক্রিয় হস্তক্ষেপের দিকে এগতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সোমবারেই প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন রণতরী ইএসএস নিমিৎজ ভারত মহাসাগর হয়ে পশ্চিম এশিয়ার দিকে এগিয়েছে। এই সংঘাতে আমেরিকা কোনোভাবে ঢুকতে গেলে তা অচিরেই পুরোদস্তুর যুদ্ধের আকার নিতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এদিন ফের ট্রাম্প সমাজ মাধ্যমে লেখেন, ‘‘সংঘর্ষ বিরতির একমাত্র শর্ত, ইরান পরমাণু বোমা বানাতে পারবে না!’’ ট্রাম্প, ইজরায়েল ও ন্যাটো শরিকরা একাধারে ইরানের বিরুদ্ধে গোপনে পরমাণু বোমা তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুললেও, খোদ আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থাই এই দাবি বহুবার উড়িয়ে দিয়েছে। গত মার্চে ট্রাম্প প্রশাসনের গুপ্তচর প্রধান তুলসি গাবার্ড মার্কিন সংসদে স্পষ্ট জানান, তাঁদের তদন্ত অনুযায়ী পরমাণু বোমা তৈরি করতে ইরানে কোনোরকম গবেষণা চলছে না! 
ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের মধ্যেই কানাডায় চলছে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জি-৭ দেশগুলি চলতি সংঘাতে ইজরায়েলের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছে। একই সঙ্গে ইরানকে পশ্চিম এশিয়ার যাবতীয় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য একক ভাবে দায়ী করা হয়েছে। ইজরায়েলের হামলার জন্য ইরানের পারমাণবিক গবেষণাই দায়ী বলে দাবি করা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে শান্তির একমাত্র শর্ত হবে হিসাবে ইরানের সরকারকে আশ্বাস দিতে হবে, পারমাণবিক অস্ত্র তেহরান কোনোদিন তৈরি করার কথা ভাববে না। এই শর্ত যাতে ইরান ‘মানতে বাধ্য হয়’, তার জন্য জি-৭ দেশগুলিকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে বলে প্রস্তাব করা হয়। অথচ সংঘর্ষ বিরতির পক্ষে বিবৃতি সওয়াল করা হয়নি। বরং বকলমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় পশ্চিমি দেশগুলির ইজরায়েলকে আরও সক্রিয় ভাবে মদত দেওয়া উচিত বলে দাবি করা হয়! জি-৭ সদস্য দেশগুলির এই বিবৃতিকে ‘পশ্চিমি দ্বিচারিতা’ বলে কটাক্ষ করেছে ইরানের বিদেশ মন্ত্রক। 
এদিকে মঙ্গলবার জি-৭ বৈঠক থেকে আগেই বেরিয়ে আসেন ট্রাম্প। ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতি করিয়ে দিতেই তিনি বৈঠক শেষ হওয়ার আগে বেরিয়ে গেছেন বলে দাবি করেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ। তার মাধ্যমে সংঘর্ষ বিরতির বিরুদ্ধে জি-৭ দেশগুলির গৃহীত অবস্থান থেকে ট্রাম্প সরে আসছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। পালটা সোশাল মিডিয়ায় ট্রাম্প বলেন, ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে কোনোরকম সংঘর্ষ বিরতি করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা তাঁর নেই। তার থেকেও গুরুতর একটি কাজের উদ্দেশ্যে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। প্রসঙ্গত দিন দুয়েক আগে সোশাল মিডিয়া পোস্টে ট্রাম্প দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতি করিয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। মঙ্গলবার ডিগবাজি খেয়ে তিনি সংঘর্ষ বিরতির বিরুদ্ধে সরব হলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা গিয়েছে, ট্রাম্প সংঘর্ষ বিরতির বদলে ‘আরও বড় মাপের এমন কোনও সমাধান চাইছেন যা চিরতরে এই সমস্যা মেটাবে’। পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন রণতরীর হঠাৎ আগমনে, ইরাকের উদাহরণ ধরে ট্রাম্প এই ‘বড় সমাধান’-র কথা ভাবছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ইজরায়েলকে সমর্থন করতে গিয়ে, সংঘর্ষ বিরতির বিরুদ্ধে পশ্চিমি দেশগুলির অনড় অবস্থান গোটা দুনিয়াকে আরও এক বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল। 
অন্যদিকে মঙ্গলবার চলতি সংঘাত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং। ইরানে ইজরায়েলের হামলার জেরেই পশ্চিম এশিয়ায় নতুন করে উত্তেজনা বেড়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ এদিন বলেন, ‘‘ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে সমঝোতায় আমরা মধ্যস্থতা করে দিতে রাজি! এমন প্রস্তাব আমরা আগেও দিয়েছি। তবে ইজরায়েলের তেমন সদিচ্ছা নেই বলেই মনে হয়েছে।’’ সোমবারেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেওয়ায় তাঁর পাশাপাশি পুতিনকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, তেহরানে পাঠরত ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। অন্যান্য বাসিন্দাদের তেহরান ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইরানের বাসরত প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে তেহরানের ভারতীয় দূতাবাস প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছে।  
 
Iran Israel
মোসাদ দপ্তরে হামলা ইরানের, 'নিঃশর্ত আত্মসমর্পন’ চাইছেন ট্রাম্প
                                    
                                
                                    ×
                                    
                                
                                                        
                                        
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0