মঙ্গলবারই মালয়ালম টিভি চ্যানেল মিডিয়া ওয়ানকে নিষিদ্ধ করার কেন্দ্রীয় নির্দেশ খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, দেশে এখন জাতীয় সুরক্ষার নামে নাগরিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়া চলছে। তারিখ ছিল ৫ এপ্রিল। ঠিক তার এক দিন পরে, বুধবার (৬ এপ্রিল) মোদী সরকারের সমালোচনা করার নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে তথ্য প্রযুক্তি বিধি (২০২১) সংশোধন করেছে কেন্দ্র। সেই সংশোধনীর মাধ্যমে সোস্যাল মিডিয়ায় মোদী সরকার সম্পর্কে উপস্থাপিত কোনও তথ্য ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কি না, তা খতিয়ে দেখার একচ্ছত্র ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সংবাদ সংস্থা পিআইবি বা প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর হাতে। তার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্রের বৈদ্যুতিন ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক। কার্যত মোদী সরকারের সমালোচনা বা বিরুদ্ধচারণ করে সোস্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করা হলেই তাকেই ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই সংশোধনীতে, অভিযোগ উঠেছে এমনই। প্রতিবাদেও সরব হয়েছে বিভিন্ন মহল।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বলেছে, সোস্যাল মিডিয়া যাঁরা ব্যবহার করেন, অপছন্দের পোস্ট হলেই তাঁদের বিরুদ্ধে একতরফা সেন্সরশিপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করেছে মোদী সরকার। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এই সংশোধনী এখনই প্রত্যাহার করার দাবিও জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া বলেছে, দেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই সংশোধনী। এডিটর্স গিল্ড একে দানবীয় সংশোধনী বলেও অভিহিত করেছে এবং প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
পলিট ব্যুরো শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, এই সংশোধনীতে মোদী সরকার সম্পর্কে সোস্যাল মিডিয়ায় কোনও পোস্টের তথ্য ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পিআইবি-কে। সংশোধনী অনুসারে, পিআইবি’র তা মনে হলে ফেসবুক, টুইটার বা গুগলের মতো সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে সেই পোস্ট মুছে দিতে বলবে। তারা তা করতে না চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখে পড়বে। ব্যবহারকারীদের বেআইনি বা মিথ্যা তথ্যের পোস্টের ক্ষেত্রে সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি দায়হীনতার প্রশ্নে যে সুরক্ষার নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে, তা হারাবে তারা।
পিআইবি-কে এমন একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া মানে একতরফা সেন্সরশিপের ব্যবস্থা করা, যা সমস্যায় ফেলবে এই সব প্ল্যাটফর্মের সমস্ত ব্যবহারকারীকে। এই সংশোধনী সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, কোনওভাবেই তাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অবিলম্বে তথ্য প্রযুক্তি বিধির এই সংশোধনী প্রত্যাহার করতে হবে।
এদিনই এক বিবৃতিতে এডিটর্স গিল্ড বলেছে, সোস্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্র সংক্রান্ত কোনও পোস্ট ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কি না, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চরম ক্ষমতা নিজেই নিজেকে দিয়েছে। সেই সঙ্গে সংশোধনীতে বলা হয়েছে, পিআইবি বললেই এমন পোস্টকে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি। কিন্তু সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্টের সত্যতা যাচাই করার সরকারি পদ্ধতি বা কাঠামো কী হবে। বিজ্ঞপ্তিতে পিআইবি’র সিদ্ধান্তের বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা বা তার বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার নিয়েও কিছু বলা হয়নি। শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ভারত সরকারের মামলায় সোস্যাল মিডিয়ার পোস্ট মুছে দেওয়া বা সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কিছু নির্দেশিকা ঠিক করে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে তা কীভাবে মেনে চলা হবে, তাও জানানো হয়নি সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে। এই সবই ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী এবং সেন্সরশিপের সমতুল। গিল্ডের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে একবার এমন কিছু সংশোধনীর খসড়া প্রকাশ করেছিল তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক। সারা দেশের সংবাদ মাধ্যম সংগঠনগুলির সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রক তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তখন গিল্ড বলেছিল, ভুয়ো খবরকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা শুধু সরকারের হাতে থাকতে পারে না। তাতে সংবাদ মাধ্যম সেন্সরশিপের শিকার হবে। সেই সময়ে বিষয়টি নিয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোনও আলোচনা ছাড়াই তথ্য প্রযুক্তি বিধি (২০২১) সংশোধন করে এবার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বাস্তবে এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দানবীয় বিধি আরোপ করা হয়েছে। এখনই তা প্রত্যাহার করে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে সরকারকে।
Comments :0