কেশব ভট্টাচার্য
গত ৯ আগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে তিলোত্তমার বর্বর, নৃশংস, নির্মম ধর্ষণ এবং খুনের পর রাজ্যে চূড়ান্ত বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ছবি আজ সকলের কাছেই পরিষ্কার। এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটবার পর রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অরাজক অবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য সামনে আসছে। স্তম্ভিত করে দেবার মতো বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো 'থ্রেট কালচার– বা ভয় দেখানোর সংস্কৃতি। একটু চিন্তা করলেই মনে পড়বে এই 'গ্রেট কালচারের' সংস্কৃতির সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিল। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়— ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি জনসভায় মাননীয়া বলেছিলেন– উনি গুন্ডা কন্টোল (নিয়ন্ত্রণ) করেন। এই উক্তি উনি করেছিলেন প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই আমাদের রাজ্যে রাজনীতিতে ভয় দেখানোর সংস্কৃতির শুরু হয়েছিল।
পরবর্তীকালে মাননীয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবার পর একাধিক এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন যা নজিরবিহীন এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতির সঞ্চার করার জন্য যথেষ্ট। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে হাসপাতালের সামনে জোরে মাইক বাজানো এবং লাগাতার পটকা ফাটানোর অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া দুই তৃণমূল কর্মীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সটান ভবানীপুর থানায় হাজির হন এবং থানায় উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের ধমক দিয়ে ঐ দুই দুষ্কৃতীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। তৃণমূল দলের অন্য নেতা-মন্ত্রীরাও এই বিষয়ে পিছিয়ে থাকেনি। তাই জনৈক মন্ত্রী এবং এক সাংসদ প্রকাশ্য দিবালোকে কতর্ব্যরত পুলিশ কর্মীকে চড় মারতেও দ্বিধা করেননি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শাসকের চোখ রাঙানি ক্রমশ বেড়েছে এবং তাতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। শুধুমাত্র ভয় দেখানোতেই সীমাবদ্ধ না থেকে দমন-পীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু হয় এরপর। সেই কারণেই সঠিক কথা বলা সত্ত্বেও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পার্ক স্ট্রিট দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেনকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বদলি করা হয়। ২০১৩ সালের কলকাতা বই মেলায় গাড়ি আসতে দেরি হওয়ায় মাননীয়া বলেছিলেন পুলিশ কর্মীদের চাবকানো উচিত। মাননীয়ার এই আচার আচরণ এবং তার সঙ্গে সেই মহান (!) উক্তি– উনি দামাল ছেলেদের পছন্দ করেন, সেকথা সকলের মনে আছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে বিধানসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সূর্য মিশ্রকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন মাননীয়া। এইভাবে মাননীয়া এবং তাঁর দলের দামাল ছেলেরা সমাজের সর্বস্তরে এক থ্রেট কালচার চালু করেন।
সন্দেশখালির ঘটনা সকলের স্মরণে আছে কিভাবে শেখ শাহজাহান এবং তার দামাল সাঙ্গোপাঙ্গরা ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়ে গেছে দিনের পর দিন। অন্যের জমি, সম্পত্তি দখল করার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে মহিলাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছে বহুদিন ধরে। পুলিশ-প্রশাসনের মদতে থ্রেট-সিন্ডিকেটে দাপটে সন্দেশখালির মানুষ চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছেন ।
রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে থ্রেট কালচারের একাধিক ঘটনা ঘটেছে ২০১১ সালের পর থেকে। ২০১২ সালে তৎকালীন রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যাপক দিলীপ দে সরকারকে কলেজের ভিতরে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে, তাঁর শরীরে থুতু ছিটিয়ে চূড়ান্ত হেনস্তা করা হয়। এরপর সাংবাদিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্ন করলে উনি বলেছিলেন– ছোট ছোট ছেলেরা করে ফেলেছে। ঐ ২০১২ সালেই একটি কার্টুন ফরোয়ার্ড করার অপরাধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেলে ভরেছিল তা৬র পুলিশ। কোন্নগরের হীরালাল পাল কলেজের অধ্যাপক সুব্রত চ্যাটার্জিকেও কলেজের ভিতরেই শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দামাল ছেলেরা। রাজ্যের একাধিক স্কুলেও শিক্ষকদের শারীরিক আক্রমণ করা হয়েছে। রাজ্যের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোনও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, নেই খোলামেলা পরিবেশ, নেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে মনোনীত কিছু ব্যক্তিকে দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনা করা হচ্ছে। আর সরকার মনোনীত এই সব স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি দামাল ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এক ধরনের ‘থ্রেট সিন্ডিকেট' চালু করেছে যাতে সেখানে চলতে থাকা বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ যাতে মুখ খুলতে না পারে সেটা সুনিশ্চিত করাই এই থ্রেট সিন্ডিকেটের কাজ।
পি জি হসপিটালে কুকুরের ডায়ালিসিসের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বেহাল দশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ওয়াকিবহাল হন। ঐ বেনজির ঘটনাটি সামনে আসার পর মিডিয়ায় হই চই হয়েছিল, হয়েছিল কিছু প্রতিবাদ। কিন্তু সেই প্রতিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্প্রতি আর জি কর হসপিটালে তিলোত্তমাকে ধর্ষণ করে খুন করার পর রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের যে চূড়ান্ত অরাজক অবস্থা সেটি ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। উত্তরবঙ্গ লবি, থ্রেট সিন্ডিকেট, থ্রেট কালচার, শব এবং শবের দেহাংশ নিয়ে ব্যবসা, একে একে প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিলোত্তমার বর্বর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর রাজ্যের চিকিৎসকরা সমস্ত ভয়ভীতি বিসর্জন দিয়ে বিচারের দাবিতে পঞ্চাশ দিনেরও বেশি সময় ধরে নজিরবিহীন ভাবে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সারা দেশে এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও সংগঠিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন ছাত্র-যুব–মহিলা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলি। মানুষের এই প্রতিবাদকে থামাবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি তৃণমূলীরা। তৃণমূলের একাধিক নেতা-নেত্রী নানান কুরুচিকর অপমানজনক মন্তব্য করেছেন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে। একাধিক জায়াগায় শারীরিক আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে প্রতিবাদী মানুষের উপর। কিন্তু এই সব চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে জারি থেকেছে আন্দোলন এবং তারই ফলস্বরূপ কলকাতার পুলিশ কমিশনার সহ আরও কিছু ব্যক্তি তাদের পদ থেকে অপসারিত হয়েছে।
একথা ঠিক লাগাতার গণআন্দোলনের ফলে জুনিয়র ডাক্তারদের কিছু দাবি আদায় হয়েছে। কিন্তু মূল যে দাবি তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং খুনের সঠিক বিচার– সেই দাবি এখনও মেটেনি। আর প্রশ্নটা সেখানেই। আসলে শাসকের চরিত্র কি কেন্দ্র, কি রাজ্য সর্বত্র একই। কেন্দ্রে বিজেপি একইভাবে থ্রেট কালচার চালিয়ে যাচ্ছে— হেমন্ত সোরেনের গ্রেপ্তার, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার, এমন কি প্রবীর পুরকায়স্থকে (UAPA) তে গ্রেপ্তার বিজেপি’র দমন পীড়নমূলক ভীতি প্রদর্শনের রাজনীতির উদাহরণ। এছাড়া বিজেপি এবং তৃণমূলের সেটিং তো আছেই, নাহলে তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং খুনের সঠিক বিচারের দাবিতে গোটা দেশ যখন উত্তাল, তখন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত কি করে বলেন, এই বিষয়ে রাজ্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে ওঁনারা সেটাকেই সমর্থন করবেন! মহামান্য আদালত, সিবিআই, ইডি’র প্রতি আস্থা রেখেও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই সংস্থাগুলির তদন্তের উপর নির্ভর করে মহামান্য আদালত কি রায় শোনাবেন জানা নেই। ন্যায়বিচার হবে! নাকি সেখানেও সেটিং? চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজিয়ে থ্রেট করার কারিগরের জামিনের পর এই সন্দেহ আরও বেশি করে দানা বাঁধছে।
তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের সঠিক বিচারের দাবিতে, থ্রেট কালচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রাজ্যজুড়ে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের পরেও তৃণমূলের থ্রেট সিন্ডিকেটের দামাল ছেলেদের দাপাদাপি বন্ধ হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। নানা কায়দায় প্রতিবাদীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদীদের উপর শারীরিক আক্রমণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাঁকুড়ার টিডিবি কলেজে এক অধ্যাপক যিনি তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক, কয়েকজন ছাত্রীকে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করার অপরাধে (?) ক্লাসে ঢুকতে দিচ্ছেন না। এখানেই শেষ নয়– সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নিরন্তর লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাত্র, যুব, মহিলাদের এই গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেবার কারণে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হছে। একটি অডিও ক্লিপের ভিত্তিতে তৃণমূলের দলদাস পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে কলতান দাশগুপ্তকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢোকানো হলো। এরকম আরও ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মাননীয়ার আমদানি করা থ্রেট কালচার এবং থ্রেট সিন্ডিকেটের শিকড় সমাজের গভীরে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সমাজকে সুস্থ, সুন্দর করে তুলতে থ্রেট কালচারের বিষবৃক্ষকে সমূলে বিনষ্ট করার জন্য আপসহীন লাগাতার গণআন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে– এটাই সময়ের দাবি।
Post Editorial
সেই থ্রেট কালচার সমানে চলছে
×
Comments :0