সংসার চালাতে ভরসা ছিল তাঁতের কাজ। তবে বাজারে শাড়ির চাহিদা নেই। অভাবের গ্রাস ক্রমশ আগ্রাসী হচ্ছিল। শেষমেশ আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন ৩২ বছরের তাঁত শিল্পী, দাবি পরিবারের। মৃতের নাম জয়দেব বসাক (৩২)। বাড়ি পূর্বস্থলী-১ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত নশরতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পারুলডাঙ্গা গ্রামে। শুক্রবার রাতে বাড়িতের গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন বলে পরিবারের তরফে জানা গেছে। মৃতের দিদি সরস্বতী বসাক জানান, ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল তাঁত চালিয়ে দুই বোন ও মাকে সুখে রাখবেন। কিন্তু তাঁত শিল্পের ভয়ংকর পরিস্থিতিতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। চরম হতাশার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করতেন। কয়েক মাস আগে রাগে ক্ষোভে নিজের তাঁতঘরে একদিন আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমাদের দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মা ভাইয়ের সঙ্গেই থাকতেন। কিন্তু অভাবের কারণে মাও একদিন তাঁর কাছে বড়ই বোঝা হয়ে যায়। মা বর্তমানে আমার কাছে রয়েছেন। বাড়িতে একাই থাকতো ভাই, পরের তাঁতঘরে কাজ করে কোন রকমে নিজেই রান্নাবান্না করে খেত। কিন্তু কাজ না থাকার কারণে সেটাও তার কাছে কষ্টের হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাত্রে সব কিছু একটি কাগজে লিখে গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ে। শনিবার সকালে মৃতদেহ উদ্ধার করে কালনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ময়নাতদন্ত হয়।
ওই এলাকায় এটাই তাঁত শিল্পীদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রথম নয়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি রাত্রে এই এলাকার হাটশিমলা গ্রামে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন একজন ঋণগ্রস্ত তাঁতশিল্পী নিমাই বসাক। তিনি তাঁত ঘরেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েন। নসরতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পার্শ্ববর্তী সমুদ্রগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের কালীতলায় গত ১২ জুলাই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন সহদেব সরকার নামের একজন তাঁত শিল্পী।
উল্লেখ্য করোনা ভাইরাসের জেরে লকডাউন, ইয়াস ঝড়-বৃষ্টির তান্ডবে কালনার তাঁতশিল্প ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে যায়। সেই সময় রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতেও কৃষি ফসল সহ তাঁত শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কথাও উঠে আসে। এই নিয়ে রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও সেই ক্ষতিপূরণের অর্থ এইসব আত্মঘাতী হওয়া তাঁত শিল্পীদের কাছে পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ।
যন্ত্রদানব পাওয়ারলুমও এসেও কালনার হস্তচালিত তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করতে পারেনি। কালনা মহকুমায় ষাট হাজার মানুষ এই হস্তচালিত শিল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্ত করোনা প্রকোপে এই শিল্প একেবারেই লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার ফলে বহু তাঁতশিল্পী কাজ হারান। প্রায় তাঁতের মাকুর আওয়াজ থেমে যায়। তাঁতঘরে শুধু প্রায় ফাঁকা তাঁতগুলো সারি সারি অযত্নে পড়ে আছে। এই চিত্র কালনা মহকুমা কালনা শহর, ধাত্রীগ্রাম, কাদিপাড়া, পূর্বস্থলীর নশরতপুর, সমুদ্রগর, মাজিদা, শ্রীরামপুরের মতো তাঁতশিল্প নিবিড় এলাকা গুলিতে। এদিন জয়দেব বসাকের মৃতদেহের সাথে আসা ধাত্রীগ্রামের আনন্দ বসাক জানান, তিনিও একজন তাঁত শিল্পী ছিলেন। বাড়িতে পাঁচটি তাঁত পড়ে রয়েছে। এখন তিনি টোটো চালিয়ে কোনরকমে সংসার চালান। তার কারণ, সাধারণত এখানে ঢাকাই জামদানি শাড়ি বেশি উৎপাদন হত। আর এই শাড়ি বেশির ভাগই বুনতেন উত্তরবঙ্গ থেকে আসা পরিযায়ী তাঁত শ্রমিকরা। কিন্তু লকডাউনে তারা বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আর এদিকে কেউ পা বাড়াননি। অন্যদিকে জীবন জীবিকার টানে এখানকার তাঁত মালিকরা নিজেরাই শ্রমিক হয়ে গিয়ে তাঁতে বসে যান। কাপড় বুনলে কি হবে, উৎপাদিত তাঁত কাপড়ের কোন বেচাকেনা নেই। খরিদ্দার না থাকায় ১২ শো টাকা মূল্যের কাপড়ের দাম নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে চারশো টাকায়। ফলে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন তাঁত শিল্পীরা। তাই তাঁত ছেড়ে আনন্দ বসাকের মতো অনেক শিল্পীরা আজ অন্য পেশায় নিযুক্ত।
Comments :0