তাঁদের এ কাজ করার কথা নয়। আপত্তিও জানিয়েছেন তাঁরা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে জোর করে আশাকর্মীদের দিয়ে করানো হচ্ছে আবাসপ্লাসের সমীক্ষা। হুগলীতে এক আশাকর্মীর বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনায় এই ভাষাতেই ক্ষোভ জানিয়ে সরব হয়েছেন তাঁর সহকর্মীরা।
গভীর রাতে আশাকর্মীর বাড়ির পাটের গাদায় আগুন লাগে। ঘটনায় অসুস্থ আশাকর্মীকে ভর্তি করা হয়েছে জিরাট হাসপাতালে। আবাসপ্লাস যোজনার কাজে নামার জেরেই পাটের গাদায় আগুন লাগানো হয়েছিল, এমনই শঙ্কা জানিয়েছে হাসপাতালে ভর্তি আশাকর্মী সরস্বতী ঘোষের পরিবার। বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়ায়-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের আশাকর্মী সরস্বতী ঘোষ। তাঁর বাড়ি আয়দা ঘোষপাড়ায়। গভীর রাতে বাড়ির পাশে পাটের স্তূপে ধরানো হয় আগুন।
দিনকয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী রেবা বিশ্বাস। তাঁকেও নামতে বাধ্য করা হয়েছিল আবাসের সমীক্ষায়, অভিযোগ তাঁর সহকর্মী এবং পরিবারের। পাকা বাড়িকে কাঁচা বলে দেখানোর কারচুপি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সমীক্ষার সময়। প্রশাসন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রতিবাদেও শামিল হয়েছেন শ্রমজীবীরা। তারপরই বৃহস্পতিবার সামনে এল সরস্বতী ঘোষের ঘটনা।
‘আশা’ বা সহায়ক স্বাস্থ্য কর্মী এবং অঙ্গনওয়াড়ি বা আইসিডিএস কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা এমনিতেই নেই। বেতনও নেই। ভাতা হিসেবে মেলে সামান্য অর্থ। অথচ মা ও শিশুদের পুষ্টি থেকে জনস্বাস্থ্য কাঠামোর অন্যতম ভিত তাঁরা। সারা দেশেই তাঁরা এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব।
এ রাজ্যে তাঁদের অসহায়তার সুযোগে কিভাবে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে জানিয়েছেন সরস্বতী ঘোষের সহকর্মী ডলি চ্যাটার্জি। তিনি বলেছেন, ‘‘গত তিন তারিখে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বলা হয় আবাস প্লাসের কাজ করতে। আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা এই কাজ করতে চাইনি। এক প্রকার জোর করে আমাদের এই কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আর কাজ করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী সমীক্ষা করছি আমরা। বাড়ি দেওয়া আমাদের কাজ না। সরস্বতীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। ও পুড়ে মরে গেলে তার দায় কে নেবে।’’ তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘আমরা আশাকর্মীরা আবাস সমীক্ষার কাজ করতে চাইছি না। মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করি। সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক। কিন্তু এই আবাসের সমীক্ষায় নেমে বিপদের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।’’
সরস্বতী ঘোষের প্রতিবেশী মৌমিতা ঘোষ জানান যে প্রথমে আগুন দেখতে পান তিনি। এরপরেই ডাকাডাকি শুরু করেন। আশাকর্মীর স্বামী সুদাম ঘোষ জানান, রাতে দোতলার ঘরে ঘুমিয়েছিলেন তাঁরা প্রতিবেশির ডাকাডাকিতে উঠে পড়েন। দেখেন আগুন জ্বলছে বাড়ির সামনেই জড়ো করা পাটের গাদায়। তড়িঘড়ি জল ঢেলে আগুন নেভান। আশাকর্মীর স্বামী আরও বলেন,"আমাদের কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই। স্ত্রী আশাকর্মী। আবাস প্লাসের সমীক্ষার কাজ করছেন। গুপ্তিপাড়ায় ১৬৩ টা আবাস প্রকল্পের উপভোক্তার নাম এসেছে।" আর সেই থেকেই এই ঘটনা বলে সন্দেহ। বৃহস্পতিবার সকালে ওই আশাকর্মীর সহকর্মীরা তাঁর বাড়িতে যান।
ঘটনার তদন্তে যান বলাগর বিডিও নীলাদ্রি সরকার। বিডিওকে সামনে পেয়ে তাদের কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা জানান আশাকর্মীরা। বিডিও নীলাদ্রি সরকার বলেন, ‘‘যদি কোন আশা কর্মীকে হুমকি বা ভয় দেখানো হয় তাহলে আমরা বলেছি তাদের নাম এবং ফোন নম্বর আমাদের দিতে। কিন্তু এরকম কোনো কিছু পাইনি। এখন এই ঘটনা ঘটে গেছে। হয়ত উনিও বুঝতে পারেননি এমন একটা বড় ঘটনা ঘটে যাবে। যারা সমীক্ষার কাজ করছে তারা তো একই এলাকার লোক। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে এর পিছনে কারা রয়েছে।"
সিপিআই(এম) হুগলি জেলা কমিটির সদস্য অতনু ঘোষ বলেন, ‘‘এই প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনায় আশা আর অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের যুক্ত করা এই রাজ্য সরকারের একটা কৌশল। সরকার চাইছে পঞ্চায়েত সদস্যদের আড়াল করতে। স্থানীয় মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত। পুপ্তিপাড়ার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
আবাস যোজনায় কারচুপিতে গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। সামনে পঞ্চায়েত ভোটও রয়েছে। কারচুপির, দুর্নীতির, কাটমানির চক্র ঘিরে ক্ষোভ আড়াল করতে সামনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে এই মর্মে সরব বিভিন্ন অংশ।
ক্যাপশন: সরস্বতী ঘোষের বাড়ির পাশে পুড়ে যাওয়া পাটের গাদা।
Comments :0