Biri Workers

কমছে মজুরি! প্রতারণায় ক্ষুব্ধ বিড়ি শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধে

রাজ্য


অনির্বাণ দে : জঙ্গিপুর

 যত দিন যাচ্ছে, কমছে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিড়ি মালিকদের বৈভব। বিড়ির ব্যবসা বাড়িয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিক্রি করছে মালিকরা। কিন্তু বাড়ছে না শ্রমিকের মজুরি। এভাবে কম মজুরি আর মানা যাবে না। প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। রবিবার মুর্শিদাবাদের সাজুর মোড় ও উমরপুর মোড়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে মালিক সংগঠনগুলিকে হুঁশিয়ারি দিলেন বিড়ি শ্রমিকরা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সাগরদিঘিতে তৃণমূলের ভোট প্রচারে এসেছিলেন ভাইপো-সাংসদ ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি। সেই সভা থেকে তিনি বলেছিলেন, দেড় মাসের মধ্যে বাড়বে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি। মজুরি নাকি হবে ২৪০ টাকা। মঞ্চ থেকেই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিড়ি-মালিক সাংসদ খলিলুর রহমান ও বিড়ি-মালিক বিধায়ক জাকির হোসেনকে।  অভিষেকের ভাষণ নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটেও পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করেছে তৃণমূল নেতারা। তারপর এক টাকাও বাড়েনি বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি। কেন এই প্রতারণা? রাস্তায় নেমেই প্রশ্ন করেছেন বিড়ি শ্রমিকরা।  
এদিন বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল আন্দোলন ভাঙতে। বাজারে মজুরি বাড়ানোর কথা ছড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ, বিড়ি-মালিক খলিলুর রহমান। কাজ বন্ধেরও ভয় দেখানো হয়েছে তৃণমূলের পক্ষ থেকে। সেই ভয় ও বিভ্রান্তি কাটিয়েই এদিন রাস্তা অবরোধে নেমেছিলেন  সাগরদিঘি থেকে ফরাক্কার বিড়ি শ্রমিকরা। এদিন সমাবেশে সিআইটিইউ জেলা সম্পাদক জ্যোতিরূপ ব্যানার্জি বলেন, “আগে নিজের কোম্পানিতে মজুরি বাড়ান সাংসদ, তারপর বলবেন অন্য কথা। মুখের কথায় আন্দোলন ভাঙা যাবে না। সরকার, মালিক, শ্রমিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করে হকের মজুরি দিতে হবে।’’
কিন্তু হকের মজুরি কত মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিকদের ?
রাজ্য সরকারের বিড়ি শ্রমিকদের মজুরির শেষ বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল তিন বছর আগে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সেই ন্যূনতম মজুরির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, হাজার বিড়ি বেঁধে ২৬৭ টাকা ৪৪ পয়সা পাবেন মুর্শিদাবাদ জেলার বিড়ি শ্রমিকরা। কিন্তু কোথায় সেই মজুরি?
দু’বছর আগে ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেষবারের মতো  হয়েছে বিড়ি শ্রমিক সংগঠনগুলি ও মালিক সংগঠনের মধ্যে চুক্তি।  সেই চুক্তি অনুযায়ী হাজার বিড়ি বেঁধে ১৭৮ টাকা মজুরি পাওয়ার কথা বিড়ি শ্রমিকদের। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে চুক্তি কার্যকর হলেও এখনও বহু বিড়ি-মালিক সেই মজুরিটুকুও দেন না। অন্যদিকে প্রতিদিন কমছে সেই মজুরিও। কোথাও ১৫০ টাকা, কোথাও ১৬০ টাকার বিনিময়ে হাজার বিড়ি বাঁধতে হচ্ছে শ্রমিকদের। মজুরির দাবি করলেই শুনতে হচ্ছে কাজ ছাড়িয়ে দেওয়ার নিদান।
“কাজ কেন ছেড়ে দেব? এতদিন বিড়ি বাঁধছি। এক টাকাও পিএফ দেয়নি মালিক। এতদিন কম মজুরিতে বিড়ি বাঁধাচ্ছে। আজ কাজ ছেড়ে দিতে বললেই হলো?”, প্রশ্ন তুলছেন কাবিলপুরের নাসরিনা খাতুন, সুতির মনসুরা বেওয়ারা। তাই সপরিবারেই এসেছেন পথ অবরোধে, সোচ্চার হয়েছেন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে।
বিড়ি মজদুর অ্যান্ড প্যাকার্স ইউনিয়নের জেলা সভাপতি মহম্মদ আজাদ বলেন, জঙ্গীপুর মহকুমার বেশিরভাগ বিধায়কই বিড়ি-মালিক। জঙ্গিপুরের সাংসদও বিড়ি-মালিক। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতির চেয়ারেও বসানো হয়েছে বিড়ি-মালিক পরিবারের রুবিয়া সুলতানাকে। তাই শ্রমিকদের মজুরি দেখার জন্য আস্ত একটা দপ্তর থাকলেও সেই শ্রম দপ্তরের কর্তারাও চোখে ঠুলি পরে বসে থাকছেন। তবে নিজেদের দাবি আদায়ে অনড় শ্রমিকরা।
তাই শ্রমিকদের সামনে রাস্তায় নামা ছাড়া পথ নেই। এদিন উমরপুর ও সাজুর মোড়ে সভার পর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখানো হয়। আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিড়ি শিল্পে যুক্ত সংগ্রাম কমিটি। সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি ছাড়াও আন্দোলনে ছিলেন ইউটিইউসি, এআইটিইউসি, এফআইটিইউ, এআইইউটিইউসি, এআইসিসিটিইউ’র নেতাকর্মীরা। 
এদিন সাজুর মোড়ের সভায় মহম্মদ আজাদ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ নেতা মোজাফ্‌ফর আহমেদ, আইএনটিইউসি নেতা আলি রেজা, ইউটিইউসি নেতা নিজামুদ্দিন আহমেদ, এফআইটিইউ’র হামিদ শেখ। সভা পরিচালনা করেন হুমায়ুন রেজা ও অমল চৌধুরি।
উমরপুরে বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক ও বিড়ি মজদুর অ্যান্ড প্যাকার্স ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক জ্যোতিরূপ ব্যানার্জি, সিআইটিইউ নেতা শুভাশিস মুখার্জি, ইউটিইউসি’র জিয়াউর রহমান, এআইইউটিইউসি’র নাসিরুদ্দিন মির্জা।
তারাপুরে বামপন্থীদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল বিড়ি হাসপাতাল। সেই সময় সাংসদ ছিলেন আবুল হাসনাৎ খান, তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু ইএসআই সেই হাসপাতাল অধিগ্রহণের পর চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না বিড়ি শ্রমিকরা। ওই হাসপাতালে বিড়ি শ্রমিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন বিড়ি শ্রমিকরা। সব শ্রমিককে ইএসআই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়ার দাবি তুলেছে শ্রমিক সংগঠনগুলি।
শ্রমিক নেতারা বলেন, পুজো আর ঈদে কাপড় দিয়ে, কারো হাতে দু-এক হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে দাতা সাজছেন বিড়ি-মালিকরা। ওই টাকাও এসেছে বিড়ি শ্রমিকদের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে। এসব চলবে না। বিড়ি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে।
শুধু মুর্শিদাবাদ নয়। অরঙ্গাবাদে চুক্তির উপর নির্ভর করেন বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারের বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি। ঝাড়খণ্ডের পাকুড় ও সাহেবগঞ্জ জেলার ২ লক্ষ বিড়ি শ্রমিকও মজুরি পান এই চুক্তি অনুসারে।
 

Comments :0

Login to leave a comment