দাঁড়িয়ে থেকেই দশজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার গণহত্যা করেছিল তৃণমূল কর্মী বড় লালন শেখ। সম্পূর্ণ তথ্য প্রমাণ রয়েছে সিবিআই’র চার্জশিটে। চার্জশিটে অন্যতম অভিযুক্ত এই বড় লালন শেখ, দীর্ঘদিন ফেরারও ছিল।
বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর তৃণমূল কর্মীদেরই পুড়িয়ে মারার সেই ঘটনায় বড় লালন শেখের কোনও দোষ খুঁজে পেলেন না এলাকার তৃণমূল সাংসদ! গণহত্যার পর দশ দশটি লাশ নিয়ে যখন শোকে বাকরুদ্ধ বগটুইয়ের স্বজনহারা পরিবারগুলো তখনও একবারের জন্য তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি এলাকার সাংসদ। অথচ সেই দশ খুনে সরাসরি অভিযুক্তের যখন সিবিআই হেপাজতে রহস্য মৃত্যু হয়েছে তখন ‘সিবিআই’র সম্পূর্ণ দোষ, ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেয়ে এলাকায় পৌঁছে গেলেন সাংসদ শতাব্দী রায়।
গ্রামে বড় লালনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে পাশে থাকার পর্যন্ত আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁরা যাতে সুবিচার পান তারজন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন শতাব্দী রায়।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্নই উঠেছে, গণহত্যার সময় একদিনের জন্যও শতাব্দী রায় তাঁরই সংসদ এলাকার গ্রামে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি! অথচ সেই নৃশংসতার মূল চক্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ‘সহানুভূতি’ জানাতে গ্রামে যেতে খুব বেশি দেরি করলেন না তিনি। প্রশ্ন করা হলে মন্তব্যও করেছেন সাংসদ, ‘‘ঘটনায় সিবিআই’র পুরো দোষ।’’ অবশ্য গণহত্যার পরে গ্রামে না আসা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্তব্য করতে চাননি সাংসদ।
এদিকে রবিবার হেপাজতে লালন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই-কে নোটিস ধরালো সিআইডি। চাওয়া হয়েছে ঘটনার দিনের সিসিটিভি ফুটেজ। বগটুই গণহত্যাকাণ্ডে সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিককেই এই নোটিস পাঠানো হয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে লালন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই’র ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে সিআইডি। ইতিমধ্যে বিক্ষোভের পরে নিরাপত্তার কারণে বীরভূমে সিবিআই’র অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে বগটুইকাণ্ডের তদন্তের সমস্ত নথি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সিবিআই’র তরফে জানানো হয়েছে তদন্তের সমস্ত কাগজ, নথিপত্র, ফাইল বীরভূম থেকে সরিয়ে নিজাম প্যালেসে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতিমধ্যে সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিকের বিরুদ্ধে এফআইআরও রুজু করা হয়েছে।
অন্যদিকে শতাব্দী রায়ের সফরের দিনই আরেক অভিযোগ দায়ের করেছেন বড় লালন শেখের স্ত্রী রেশমা বিবি। তাতে সিবিআই’র বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। রামপুরহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করার ব্যাপারে রেশমা বিবি বলেছেন, ‘‘বগটুইকাণ্ডের দিন রাতেই আমরা প্রাণ বাঁচাতে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। পরে সিবিআই এসে ওই বাড়ি সিল করে দেয়। সিল করা বাড়ি থেকেই আমাদের সোনার গয়না এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা চুরি গিয়েছে।’’ রবিবার দুপুরে ফের বগটুই গ্রামে মৃত লালন শেখের শ্বশুরবাড়িতে যায় সিআইডি পাঁচ সদস্যের দল। তারা এক প্রস্থ কথা বলেছেন বড় লালনের পরিবারের নানা সদস্যের সঙ্গে। গ্রামের নানা এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিআইডি’র গোয়েন্দারা।
তারই মধ্যে তৃণমূলী সাংসদ শতাব্দী রায়ের গ্রামে আসা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। রবিবার বগটুই গ্রামে গিয়ে রেশমা বিবির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর সিবিআই হেপাজতে মৃত লালনের পরিবারের পক্ষে জোর সওয়াল করেন সাংসদ। তিনি বলেন, ‘‘আমি দিদির (মুখ্যমন্ত্রী) সাথে কথা বলবো, অভিষেকের সাথে কথা বলবো। ওদের কী নির্দেশ আছে দেখে নিই। তারপর আমার দ্বারা যেটুকু সম্ভব সাহায্য করব।’’ এই আশ্বাস কিন্তু শিশু, মহিলা সহ পরিবারের দশ সদস্যকে অকালে হারিয়ে পাননি বগটুইয়ের স্বজনহারারা। সাংসদের আশ্বাস পেয়ে লালন শেখের স্ত্রী রেশমা বিবিও জানান, সাংসদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি অনেকটাই আশ্বস্ত।
রামপুরহাট আদালতের আইনজীবী মহলের অভিমত, বড় লালনের মৃত্যুতে সিবিআই’র অপেশাদারিত্ব সামনে চলে আসায় যে ঝঞ্ঝাট তৈরি হয়েছে রামপুরহাট থেকে বগটুইয়ে, তাতে সিবিআই এই মামলা রামপুরহাট থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সক্রিয় হবে। ঝঞ্ঝাটের নমুনা, বড় লালনের মৃত্যুর পরেরদিন বিক্ষোভের জেরে অপর অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরকে আদালতে তুলতে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেতে হয় সিবিআই আধিকারিকদের। শাসক তৃণমূল গোটা ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে ময়দানে নেমে পড়েছে।
ফলে ফের আতঙ্ক নতুন করে গ্রামে। রাতভর পুলিশের আনাগোনা। দিনে চারিদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, রাতেও রেহাই নেই। সবে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার দিশা পেতে না পেতেই ফের বগটুই চলে গিয়েছে ন’মাসের আগের চেহারাতেই। গ্রামজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা, তাতে সর্বক্ষণ চোখ পুলিশের। গ্রামের এই দশা কল্পনারও অতীত, খেদ সাদের আলির। বললেন, ‘‘জানি না শেষপর্যন্ত গ্রামটার কি হবে! ভেবেছিলাম এবার হয়তো সব থামবে। উলটে নতুন করে আবার ভয় লাগতে শুরু করেছে। এত এত পুলিশ না হয় এখন আছে। সারা বছর তো থাকবে না,’’ বলেই ঢুকে পড়লেন বাড়িতে।
Comments :0