চিন্ময় কর: ঘাটাল
খিদের জ্বালায় আর্তনাদ করছেন ওঁরা। অনাহার আর অপুষ্টিজনিত রোগে কঙ্কালসার চেহারা। নড়াচড়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছেন স্বামী। আর অসুস্থ শরীরেও ভিক্ষা করতে বের হতে হচ্ছে স্ত্রীকে। একমাত্র ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। আর নয়, এবার সেই মৃত্যুই চাইছেন মুখ্যমন্ত্রীর বার্ধক্যভাতা না পাওয়া ঘাটাল নিবাসী এই দম্পতি। সব জেনেও মুখে কুলুপ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের।
স্বামীর ১৩ বছর, স্ত্রীর ৬ বছর হয়ে গেল বয়স্ক ভাতা চালু হয়নি। হাতে কোনও টাকা পয়সা নেই বহু দিন হলো। দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠেছে অনাহার আর অপুষ্টি। অসুখে ভুগে কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছেন স্বামী। ওদিকে আবাস যোজনা থেকেও বঞ্চিত, ঘর বলতে প্রায় কিছুই নেই, শুধুই বস্তার ওপর ত্রিপল চাপানো। খিদের জ্বালায় আর্তনাদ শুনে প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে খাবার তুলে দেন, সেটুকুই সম্বল। সেই দম্পতি এখন সরকারের কাছে তাঁদের মৃত্যু কামনা করছেন। এমন এক মর্মান্তিক ঘটনার কথা প্রকাশ্যে এল ঘাটাল ব্লকের মনোহরপুর ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার রত্নেশ্বরবাটি গ্রামে।
ক্ষুব্ধ প্রতিবেশীদের বক্তব্য, এই হলো দুয়ারে সরকার এর নমুনা।
চার বার ক্যাম্পে লাইন দিয়ে বয়স্ক ভাতার আবেদন করেছেন ৭৩ বছরের সুশীল মাইতি আর ৬৬ বছরের অষ্টবালা মাইতি। কিন্তু তাঁদের বয়স্ক ভাতা এখনও চালু হয়নি। রোগ শয্যায় স্বামীর চিকিৎসা তো দূরের কথা, দিনে একবার খাবার জোগাড় করতে স্ত্রীকে ভিক্ষা করতে বের হতে হয়। ষাটোর্ধ মানুষকে আজ ১৩ বছর সামাজিক ভাতা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। প্রতিবেশীদের অভিমত, রেশন কেলেঙ্কারির মতো বয়স্ক ভাতাতে কেলেঙ্কারিও থাকতে পারে, আমরা তদন্ত চাই।
অসুস্থ স্বামীকে বাড়িতে রেখে বৃদ্ধাকে ভিক্ষা করতে বের হয়। খিদের জ্বালায় বৃদ্ধ ‘জল জল’ করে আর্তনাদ করেন, সেই কাতর ডাক শুনে প্রতিবেশীরা জনপ্রতিনিধিদের বারে বারে জানিয়েছেন একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু নির্বিকার প্রশাসন। গত দু’বছর হলো তাঁদের একমাত্র ছেলে জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বাম জমানায় পাট্টা পাওয়া তিন কাঠা জমি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে খেতমজুর পরিবারটি। তারপর এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় ছেলের মৃত্যু হয়। আজ এক বছর হলো এই বয়স্ক দম্পতিকে দেখার কেউ নেই।
ঘর বলতে ছিটে বেড়ার ঘর। তাতে কালো ত্রিপল চাপানো। জল বৃষ্টিতে ছিটে বেড়ার মাটি ঝরে গেছে। তাতে কুড়িয়ে ও চেয়ে আনা ছেঁড়া সারের বস্তা দিয়ে ঘেরা। দেখে বোঝাই যায় আবাস যোজনাতেও বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা। তার ওপর খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সামাজিক সুরক্ষার বয়স্ক ভাতা থেকেও বঞ্চিত।
অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা তো দূরের কথা এখন একমুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমসিম অষ্টবালা মাইতি। তিনি বলেন, ‘ওই মানুষটা বেঁচে আছে তাই বেঁচে আছি আমি।’ নইলে তিনি আত্মহত্যা করতেন। এখন সরকার তাদের ভাতাটা চালু করুক— এই আবেদন করছেন তাঁরা। ভাতা চালু না করলে তাঁদের মেরে ফেলুক সরকার- সেটাই চাইছেন। অনেকেই বিডিও দপ্তরে যেতে বলেছেন। কিন্তু সেখানে যেতে গেলে ৫০টাকা খরচ। খাবারই জুটছে না, তাই বিডিও দপ্তরে যেতে পারেননি বৃদ্ধা।
অষ্টবালা’র বক্তব্য, পঞ্চায়েত দপ্তরে দুবার দরখাস্ত জমা দিয়েছেন তাঁরা। তারপর মাড়তলা ও সামসেদপুর এমন দুই জায়গায় দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে গিয়েও বয়স্ক ভাতা চালুর আবেদন পত্র জমা দিয়েছেন। এরপর শেষ বারের ক্যাম্পে গেলে বলা হয় আর দরখাস্ত নেওয়া হবে না, লিস্টে নাম আছে। স্বামী’র ১৩ বছর আর স্ত্রী’র ৬ বছর সময় পার হয়ে গেছে। বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে পরিবারকে।
মুখ্যমন্ত্রীর হাসিমুখের দুয়ারে সরকারের হোর্ডিং তাহলে কীসের জন্য- প্রশ্ন তুলছেন এলাকাবাসীরা। শুধুই কি উদাসীনতা, নাকি এখানেও দুর্নীতি- এখন প্রতিবেশীদের চর্চার মধ্যে এসেছে এ কথাই। ভুয়ো রেশন কার্ডের দুর্নীতির মতো, আবাস যোজনা বরাদ্দ হওয়া টাকা আর একজনের অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়ার মতো বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রেও এমনটা যে হয়নি- কে বলতে পারবে। প্রশাসন থেকে প্রশাসক- আজ সবাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত— বলছেন অঞ্চলের মানুষ।
............
ক্যাপশন: ঘাটাল ব্লকের রত্নেশ্বরবাটি গ্রামে ৭৩ ও ৬৬ বছরের দম্পতি সুশীল মাইতি ও অষ্টবালা বয়স্ক ভাতা না পেয়ে অনাহারে অপুষ্টিজনিত অসুখে জর্জরিত।
Comments :0