এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে বেআইনিভাবে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর চাকরি করছেন তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠরা। তবে শনিবার চাকরি দুর্নীতিতে ধরা পড়েছেন এক বিজেপি নেতাও। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে উপেন চৌকি হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক মনোজ কুমার রায় এখন বিজেপি করেন। যখন বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছিলেন, তখন তিনি তৃণমূল করতেন। অন্যদিকে, উত্তর দিনাজপুরের তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের মেয়ে রোশনারা বেগম বেআইনিভাবে চাকরি করছেন চোপড়া ব্লকের কালিগঞ্জ হাইস্কুলে। সোনারপুরের তৃণমূল কাউন্সিলর কুহেলি ঘোষ বেআইনিভাবে চাকরি করছেন সোনারপুরের চৌহাটি হাইস্কুলে।
রাজ্যে জেলায় জেলায় স্কুলগুলিতে এমন বহু অবৈধ শিক্ষকের হদিশ মিলেছে, যারা টাকা দিয়ে বেআইনিভাবে শিক্ষকতা বা শিক্ষাকর্মীর চাকরি করছেন। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নবম-দশম শ্রেণির ৯৫২জনের ওএমআর শিট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই এই ভুয়ো শিক্ষকদের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। যে সমস্ত ভুয়ো শিক্ষকদের হদিশ মিলছে তাদের কেউ পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। এসএসসি জালিয়াতি করে নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে নিয়োগের সুপারিশপত্র দিয়েছে। এই ভুয়ো সুপারিশপত্র দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন শিক্ষক নিয়োগে সংগঠিত অপরাধ হয়েছে। এইভাবে যাঁরা শিক্ষকতার চাকরি করছেন তাঁরা ছাত্রদের কী শেখাবেন। সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। নিয়োগের সমস্ত প্যানেল বাতিল করা দরকার।
মেখলিগঞ্জের বিজেপি নেতা মনোজ কুমার রায়। তিনি মেখলিগঞ্জের উপেন চৌকি হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। ওএমআর শিট বলছে ৫৫টি প্রশ্নের মধ্যে তিনি মাত্র ১৬টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েও চাকরি পেয়েছেন। এই শিক্ষক আবার দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের ঘনিষ্ঠ! তাঁর হাত ধরেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে নেতা হয়েছেন। ওএমআর শিট জালিয়াতি প্রসঙ্গ সামনে আসতেই বিজেপি’র এই দাপুটে নেতার চাকরি রহস্য প্রকাশ্যে এসেছে। স্যোসাল মিডিয়ায় বিজেপি নেতার এই ভুয়ো চাকরির খবর প্রকাশ্যে আসতেই মনোজ কুমার রায়ের সাফাই, ‘‘আমি তো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। যে ওএমআর শিটের কথা বলা হচ্ছে সেটা আমার নয়।’’ উপেন চৌকি হাইস্কুলের পড়ুয়াদের অভিভাবকদের বক্তব্য, উনি যে টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে সেটা অনেকদিন আগে থেকেই কানাঘুষো চলছিল। আমরা চাই উনি যেন আর স্কুলে না ঢোকেন। তার ব্যবস্থা করুক শিক্ষা দপ্তর।
এদিকে বিজেপি নেতার চাকরি যাওয়া নিয়ে ব্যাকফুটে তৃণমূলও। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক তৃণমুলের যুবনেতা থাকার সময় থেকেই তৃণমুলের নেতা সুনীল রায়ের ছেলে মনোজের সঙ্গে নিশীথ প্রামাণিকের সম্পর্ক তৈরি হয়।। ২০১৯ সালে এই মনোজ কুমার রায় মেখলিগঞ্জের তৃণমূলের ব্লক সহ সভাপতিও ছিলেন। এরপরেই তিনি নিশীথ প্রামাণিকের হাত ধরে বিজেপিতে আসেন। তিনি চাকরি পেয়েছিলেন তৃণমূলে থাকাকালীনই।
প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীরের মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নিয়োগে বেনিয়মের কারণে চাকরি বাতিল হয়েছে। এবার বিধায়ক হামিদুল রহমানের মেয়ের শিক্ষকতার চাকরি চলে গেল। চোপড়া ব্লকের কালিগঞ্জ হাই স্কুলের শিক্ষিকা রোশনারা বেগম। আদালতের নির্দেশে এবারও ভুয়ো শিক্ষিকার তালিকায় নাম উঠে এসেছে রোশনারা বেগমের নাম।
বৃহস্পতিবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ৯৫২ জনের নাম এবং ওএমআর শিট প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমানের মেয়ে রোশনারা বেগমের নাম। কালিগঞ্জ হাইস্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, রোশনারা বেগম বছর দুয়েক আগে আগে নতুন নিয়োগত্র নিয়েই স্কুলে আসেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনও নির্দেশিকা আসেনি। আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারছি, সোসাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে রোশনারা বেগমের নাম। তিনি দু’দিন ধরে স্কুলে আসছেন না।’ এদিকে রোশনারা বেগমের ওএমআর শিটে ফাঁকা খাতায় নিয়োগ সম্পর্কে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা কেউ মুখ খুলতে নারাজ। তবে স্কুলের ছাত্রীদের কাছে জানা গেল, বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। আদালতের নির্দেশে আগেই চাকরি চলে গেছে ডালখোলা গার্লস স্কুলের এক শিক্ষিকার।
বেআইনিভাবে স্কুলে শিক্ষিকা পদে নিয়োগপত্র পেয়েছেন তৃণমূল কাউন্সিলর কুহেলি ঘোষ। তিনি রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সোনারপুরের চৌহাটি হাই স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষিকা কুহেলি ঘোষ ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম দশম শ্রেণির পরীক্ষায় বসে ছিলেন। স্কুল সার্ভিস কমিশন যে ৯৫২ জনের তালিকা নিজেদের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে ওই তালিকার ৪৭৪ নম্বরে নাম রয়েছে তৃণমূল কাউন্সিলর কুহেলি ঘোষের। উত্তরপত্র বিকৃত করে হরিণাভির বাসিন্দা এই তৃণমূল কাউন্সিলরের চাকরি পাওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর আগে কুহেলি ঘোষ কোদালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেআইনিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও তাঁর চাকরি হয়েছিল। তদন্ত হলেই ধরা পড়বে। যোগ্যদের বঞ্চিত করে দলীয় কর্মী, কাউন্সলিরদের এভাবেই নিয়োগ করেছে এই সরকার।
উত্তরপত্র বিকৃত করার তালিকায় তৃণমূল কাউন্সিলরের নাম থাকার বিষয়ে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ওই কাউন্সিলরের চাকরি চলে যাবে। যাওয়া উচিত। ওএমআর শিটে শূন্য পাবেন আবার চাকরিও পাবেন এটা হতে পারে না। এটা অর্গানাইজড ক্রাইম। কাউন্সিলর থেকে ওপরতলা পর্যন্ত যারা এভাবে চাকরির ব্যবস্থা করেছে তাদের সকলকে শাস্তি দিতে হবে। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মানুষের বিক্ষোভ বাড়ছে। যোগ্যরা বঞ্চিত থাকবে আর বেআইনিভাবে সম্পদের পাহাড়ে থাকবে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীরা এটা চলতে পারে না। এই দুর্নীতিতে কালীঘাট, নবান্ন যুক্ত। অমিত শাহের প্রশ্রয় পেলেও এরা বাঁচতে পারবে না।
Comments :0