Parliament

বিক্ষোভে অচল রইল সংসদ বেহাল নিরাপত্তা, চুপ কেন্দ্র

জাতীয়

নতুন সংসদ ভবনের নিরাপত্তায় বেনজির গাফিলতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ খোলার দাবিতে শুক্রবার তৃতীয় দিনেও অচল রইলো লোকসভা ও রাজ্যসভা। লোকসভায় দুই অনুপ্রবেশকারীর বেনজির বিক্ষোভের তিন দিন পরেও তাঁরা নীরব থাকায় উদ্বিগ্ন বিরোধী সাংসদরা সকাল থেকেই উভয় কক্ষে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করেন। বিরোধীদের সম্মিলিত বিক্ষোভে এদিনও শেষপর্যন্ত সংসদের অধিবেশন মুলতবি করে দিতে হয়। বানচাল হয়ে যায় নয়া তিন ফৌজদারি বিল নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির পূর্বঘোষিত সূচী।
বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা এদিন একযোগে অভিযোগ তোলেন, সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের মতো অতি স্পর্শকাতর একটি ঘটনা দেখেও লোকসভা বা রাজ্যসভায় রা কাড়ছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অথচ সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানোয় উভয় কক্ষ থেকে ১৪ জন বিরোধী সদস্যকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে এই অন্যায় সাসপেনশন প্রত্যাহার করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইস্তফার দাবিও তোলেন কেউ কেউ।
তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়ে বিরোধী সাংসদরা বলেন, সংসদে এখন অধিবেশন চলছে। সেখানে চুপ করে বসে থেকে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে গিয়ে সংসদ নিয়ে বক্তব্য রাখছেন অমিত শাহ! ওঁর এই কাজ সংসদের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের সাফ দাবি, বুধবারের ঘটনা নিয়ে অবিলম্বে সংসদ অধিবেশনে বিবৃতি দিতে হবে মোদী-শাহকে। তারপরে সেই বিবৃতি সম্পর্কে সাংসদদের পূর্ণাঙ্গ আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু লোকসভার অধ্যক্ষ বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যথারীতি এই দাবি না মানায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে দুই কক্ষেই।
সূত্রের খবর, সংসদে নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সরকার বিরোধীদের দাবি না মানলে এই বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবারই সকালে সংসদের সমন্বয় সংক্রান্ত বৈঠকে বসে ‘ইন্ডিয়া’ সাংসদরা ঠিক করেছেন, সরকারপক্ষ অনড় থাকলে সংসদেই লড়াই চলবে। তাঁদের সাফ প্রশ্ন, যে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার পাস নিয়ে বিক্ষোভকারীরা সংসদে ঢুকেছিলেন তাঁকে কেন আড়াল করা হচ্ছে? কেন তাঁকে সাসপেন্ড করা হবে না? এব্যাপারে আর কোন আপস করবেন না বিরোধীরা। এর মধ্যেই সভা বারবার মুলতবি হতে থাকায় এদিন বেলা একটায় নিজের চেম্বারে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়। কিন্তু তাঁর এই আমন্ত্রণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বিরোধী নেতারা জানিয়ে দেন, ‘‘পেছনের দরজা দিয়ে কোন আলোচনা হবে না। যা বলার সভায় সবার সামনে এসে বলুন।’’ বিরোধীদের আশঙ্কা, সংসদের নতুন ভবনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখালেই সাসপেনশনের ছক কষেছে সরকারপক্ষ। ওদের এই ‘নিউ নর্মাল’ ব্যবস্থাপনা মেনে নেওয়া হবেনা। উল্লেখ্য, সংসদীয় নিয়মে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সভায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও, বহুদিন ধরেই বিক্ষোভের এই পদ্ধতি বহাল রয়েছে। পরে এদিন সংসদ ভবন চত্বরে গান্ধী মূর্তির সামনে ঐক্যবদ্ধভাবে বিক্ষোভ দেখান বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং অন্যান্য সাংসদদের সঙ্গে গতকাল সাসপেন্ড হওয়া সদস্যরাও ছিলেন এই বিক্ষোভে। নিরাপত্তায় গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় লোকসভায় কংগ্রেসের ৯ জন, সিপিআই(এম)’র ২ জন, ডিএমকে’র ২ জন, সিপিআই’র একজন এবং রাজ্যসভায় তৃণমূলের একজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। 
প্রসঙ্গত, মাত্র সাত মাস আগে নিরাপত্তা সহ নানা প্রসঙ্গে বিপুল বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নয়া ভবনে অধিবেশন চালু হয় গত সেপ্টেম্বরে। এর মধ্যেই বুধবার দুপুরে লোকসভার দর্শক গ্যালারি থেকে আচমকা সাংসদদের বসার জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে মোদীর যাবতীয় প্রচারের ফানুস চুপসে দেন দুই যুবক। বহু-বিজ্ঞাপিত চার বলয়ের নিরাপত্তা খানখান করে সেদিন সংসদ চত্বরেও বিক্ষোভ দেখান আরও দুই যুবক-যুবতী। বিক্ষোভকারীরা যেসব দাবি জানাচ্ছিলেন তার যথার্থতা থাকলেও, যেভাবে তাঁরা সংসদ ভবনের নিরাপত্তার বেহাল চেহারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তা দেখে শিউরে উঠেছেন অনেকেই। সাংসদরাও বলছেন, এমন ঠিলেঠালা সুরক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তো যে কোন দিন বড়োসড়ো হামলাও হয়ে যেতে পারতো!
তবে এই উদ্বেগের শরিক না হয়ে মোদী-শাহেরা যেভাবে সংসদ অধিবেশনে মুখ-কান বন্ধ রাখার নীতি নিয়েছেন তাতেই ক্ষোভ বেড়েছে বিভিন্ন মহলে। গত দু’দিনও বিরোধীদের বিক্ষোভের কারণে ভেস্তে গিয়েছিলো অধিবেশন। শুক্রবারও দুই কক্ষেই একই চেহারা দেখা যায়। তেতে-থাকা বিরোধী সাংসদরা অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্রই তুমুল বিক্ষোভ শুরু করে দেন লোকসভা ও রাজ্যসভায়। মোদী-শাহের বিবৃতি এবং তা নিয়ে আলোচনার দাবিতে টানা স্লোগান চলতে থাকে দুই কক্ষেই। সভার ওয়েলে নেমেও হইচই চালান সাংসদরা। কোনভাবেই তাঁদের সামলাতে না পেরে প্রথমে বেলা বারোটা, পরে দুপুর দু’টো পর্যন্ত, এবং শেষ অবধি আগামী সোমবার পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করে দেন লোকসভার অধ্যক্ষ এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। তবে এর আগে এদিন রাজ্যসভায় বিক্ষোভ থামানোর চেষ্টায় কয়েকজন বিরোধী সদস্যকে আঙুল তুলে হুমকি দিতেও কসুর করেননি চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়। কিন্তু সেসব ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেন তিনি। ধনকড়কে অবশ্য রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, সংসদে কোন বিবৃতি না দিয়ে মিডিয়া কনক্লেভে গিয়ে বিরোধীদের গালি দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! আর প্রতিবাদী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হচ্ছে! এসব কি মেনে নিতে হবে আমাদের? এই প্রশ্নের অবশ্য কোন জবাব ছিল না ধনকড়ের মুখে।
এদিকে সংসদে বিক্ষোভ কান্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ ললিত ঝা’কে শুক্রবার সাত দিনের পুলিশ হেপাজত দিয়েছেন দিল্লির বিশেষ আদালতের বিচারক হরদীপ কাউর। বৃহস্পতিবার রাতেই দিল্লির কর্তব্য পথ থানায় ললিতের আত্মসমর্পনের খবর জানিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। এদিন তাকে আদালতে হাজির করানো হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত শুনানিতে পুলিশ দাবি করে, এই যুবকের পরিকল্পনা মতোই অন্তত পাঁচজন সংসদের ভেতরে বিক্ষোভের কর্মসূচী নেয়। সাগর, মনোরঞ্জন, অমল, নীলম এবং বিশালকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানের এই সঙ্গীদের সঙ্গে বারবার দেখা করেছিল ললিত। তার ফোনটি এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এমনকি সঙ্গীদের ফোনগুলিও সে নাকি ‘নষ্ট’ করে ফেলেছে। ললিতের ‘আসল উদ্দেশ্য’ জানার জন্য বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাই অন্তত পনেরো দিন হেপাজত দাবি করে পুলিশ। কিন্তু শেষপর্যন্ত সাত দিনের হেপাজত মঞ্জুর করেন বিচারক।
জানা গিয়েছে, ললিতের সঙ্গে যোগ রয়েছে সন্দেহ করে গত রাতেই নতুন আরও দু’জনকে আটক করে দিল্লি পুলিশ। এঁদের একজনকে ধরা হয় রাজস্থান থেকে। পুলিশের ধারণা, আত্মগোপনের সময় এঁরা ব্যক্তিই ললিতকে সাহায্য করেছিলো। আপাতত এঁদের জেরা চালাচ্ছে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল।
ধৃত যুবক-যুবতীদের মনে দেশের কৃষি সঙ্কট, বেকারত্ব, মণিপুরের হিংসার মতো সমস্যাগুলি অস্থিরতা তৈরি করেছিলো, জিজ্ঞাসাবাদের পরে তা জানিয়েছে দিল্লি পুলিশই। জেরায় জানা গিয়েছে, এসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যেই এই বিক্ষোভের পরিকল্পনা করেন তাঁরা। পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, লোকসভার ভেতরে ঢুকেও এই যুবকরা যেভাবে বিষ-হীন সাধারণ রঙিন গ্যাস ব্যবহার করেছিলেন, তাতেও তাঁদের আসল উদ্দেশ্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। কারুর কোন ক্ষতি করার উদ্দেশ্য যে তাঁদের আদৌ ছিলো না, তাও বোঝা গিয়েছে বেশ। কিন্তু সমস্যা হলো, বিক্ষোভকারীদের নিয়ে নানান তথ্য ঘটা করে জানানো হলেও সংসদের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা সম্পর্কে সরকারি তরফে কোন উচ্চবাচ্যই করা হচ্ছে না।
বরং বিরোধীদের দাবি লঘু করে সরকারকে আড়ালের চেষ্টায় এদিন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কেন বিবৃতি দিতে বলা হচ্ছে? সংসদের নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব তো লোকসভা অধ্যক্ষের। আমরা সকলেই তাঁর নির্দেশ মেনেই পদক্ষেপ করছি। বুধবারের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্তও তো শুরু হয়েছে। কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর পালটা বলেছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তো সারা দেশের নিরাপত্তা দেখার কথা। দিল্লি পুলিশও তো ওঁর দায়িত্বেই। উনি কিভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারেন? আপ সাংসদ রাঘব চাড্ডা বলেন, বিরোধীরা তো তদন্তের জন্য অপেক্ষা করতেই পারেন। কিন্তু এত বড়ো এক ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এসে বিবৃতি দিতে পারছেন না কেন? উনি টিভি’তে গিয়ে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে লম্বাচওড়া কথা বলছেন, বিরোধীদের গালি দিচ্ছেন! কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরমের কটাক্ষ, ১৪ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে সংসদের নিরাপত্তা বাড়ানো যাবে তো! অনুপ্রবেশ আটকানো যাবে তো!
 

Comments :0

Login to leave a comment