গল্প / মুক্তধারা , বর্ষ ৩
আবার আসিব
ময়ূরী মিত্র
ভিখিরি হয়েই জন্মেছে বাপ ও বাপের মেয়ে ৷ রোজ তারা ভিক্ষের চাল ডাল উনুনে ফোটায় ৷ অনেকটা জল দেয় - শিলনোড়া কাঁচা হলুদ ও কাঁচা লঙ্কা বেটে ফুটন্ত জলে দেয় এবং খিচুড়ি হয়ে গেল বলে খুশি হয় ৷ চাল ডালের পরিমাণ কম তো ! খিচুড়ির জলটা একটু ঝাল ঝাল হলে বেশি খাবার ইচ্ছেটাও চলে যায় ৷ আবার জিভেও তার আসে ৷
গঞ্জের ধারে ভিখিরি হয়ে থাকতে থাকতে কম খাওয়ার এই পদ্ধতিটা মেয়ে আবিষ্কার করেছে ৷ অবশ্য আবিষ্কারের সুখ সে পায় না ৷ প্রচণ্ড তরল খিচুড়ি উনুন থেকে নামতেই একটা থালা আর একটা বাটির মধ্যে বড্ড ঝগড়া বেঁধে যায় ৷ থালা বাপের -- থালায় ছড়িয়ে খেতে সুবিধে হবে বলে মেয়েই বাপকে থালাটা দিয়েছে ৷ কিন্তু বাপ কি বুঝবে তা ! পুরো খিচুড়ি ঢেলে দেয় পাতে ৷ মেয়ের বাটি ফাঁকা ৷ যুবতী মেয়ের পেট খিদের খাপরা হয়ে থাকলে সংসারের যে অকল্যাণ হয় তা কি বোঝে বাপটা ! রাস্তায় গড়া হলেও বাপ মেয়ের মাঝের এই চারকোণা জায়গাটুকু সংসারই তো বটে ! কথায় আছে - শিল উনুন যেখানে সংসার সেখানে ৷
ভাদ্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে এই ছড়াটাই আওড়াচ্ছিল মেয়ে ৷ বাপের পায়ে ব্যান্ডেজ ৷ সাদা ব্যান্ডেজের গা বেয়ে টাটকা রক্ত ৷ দুপুরের ঠা ঠা রোদ বাপের রক্তপা ভালো করে দেখছিল ৷ বাপের সঙ্গে ঝগড়াটা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে গো ৷ আসলে ভিখিরীর সংসারে চাল যেমন মাপা -ঝগড়াও পরিমিতি রেখে ৷ ভাষা মাকড়সার রসের মতো ৷ -কিন্তু সময় বাঁধা থাকে ৷ একটা সময় বাটি থালা গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে যায় ৷ বাড়তি খাবার ভিখিরির সংসারে বেশি ঝামেলা পাকায় ৷ না খাওয়ার সু -অভ্যেস নষ্ট হয়ে যায় যে ৷ আকাশের বদলে মন ছাদ চায় ৷বাটির সঙ্গে জল খাবার মাজা ঘটি লাগে ৷
কদিন ধরে ওই বাড়তিতেই মজে যাচ্ছিল মেয়েটা ৷ পাঁঠার দোকানের মেজ ছেলে পৈতৃক দোকান ছেড়ে নতুন লাল সিমেন্টের মেঝেতে মাংস টুকরো করে ৷ বেশ কটা টুকরো আজ মেয়েটাকে দিয়ে বলেছিল --যা বাপ লুকিয়ে আলাদা করে চচ্চড়ি করে খাগে যা ৷ গত্তি ছাড়া মেয়েমানুষের শরীর মানায় না ৷ মেয়েটা তবু হাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ কদিন ধরেই নতুন দোকান খুলে মেজোটা পাঁঠার এটা সেটা দিচ্ছে তাকে ৷ আজ দেখল --দুটো মেটে একটা বিচিও দিয়ে দিয়েছে ৷ মেজো কসাই তাড়া দিল --যা যা আর দাঁড়াস না ৷ কাস্টমার আসছে ৷ তো সেই মাংস ছোট আলুর টুকরো দিয়ে জুতিয়ে রাঁধার পর যখন খেতে যাচ্ছে ,চুলের মুঠি ধরে কী মার মারল বাপটা ! নিজের ভাগের খিচুড়ি পুরো খেল ৷ তারপর মেয়ের মাংসে টান দিল ৷ ব্যাস সব মাটিতে ৷ কুকুর চাটতে লাগল ঝোল মেটে ৷ বাপ পা দিয়ে পিসগুলো সরাবার চেষ্টা করাতে দিল কামড় ৷ গঞ্জের ডাক্তারের কাছে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে নিয়ে এই ফিরেছে বাপ মেয়ে ৷ ডাক্তারের পয়সা বাকি ৷ মেজো কসাই মেয়েকে মাংস দিলেও বাপের ব্যান্ডেজের টাকা কিছুতে দেবে না ৷ চাইতে অবশ্য মেয়ে গিয়েছিল ৷ কাস্টমারের সামনে এমন খেঁকিয়ে উঠল ! তারও তো নতুন দোকান ! তাড়াতাড়ি লাভের মুখ মেজ কসাইকে দেখতেই হবে !
ওঠ - সন্ধে হল ৷ ওঠ রে ---
ঘুম ভেঙে গেল মেয়ের ৷ বাপ রে ! না খেয়ে এত ঘুমিয়েছে সে ৷ ওই কষা মাংস খেলে অবশ্য ঘুমোতে হত না ৷ ঢেকুর তুলতে হত নাহয় হাগতে যাও বার বার ৷
আবার বলল বাপ --
ওঠ ! ভাদ্রের দুপুর হুট করে বন্ধ হয়ে সন্ধে নামে ৷ গাঁয়ে আমার ঠাকুমা বলত - ভাদ্রের দুপুরে হঠাৎ তালা পড়ে যায় ৷ দিনের ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন দরজা আছে কিনা ! ওরে ওঠ ৷ গঞ্জের বাজারের আলো কমবে এবার ৷ চ চ -- তাড়াতাড়ি খেয়ে নি ৷ আমি ফ্যানভাত করেছি ৷ বাটি নিয়ে বসে যা ৷
ভাদ্রের চাঁদে খেতে বসেছে বাপ মেয়ে ৷
বাপের ব্যান্ডেজের রঙ এখন পানের খয়ের ৷
জলওয়ালা ভাত জলের মতো সুড়ুত করে টেনে মেয়ে বলে ---
বাপ --ও বাপ --তোমার ঠাকুমার রান্নাঘরে কী কী বাসন ছিল গো বাপ ? আচ্ছা বাপ সে পান খেত ?
বাপ আর এক হাতা জোলো ভাত দিল ৷ এহে ! শুধু জল ! ফ্যানও হতে পারেনি ৷ এত জল ফ্যান হতে আগুন লাগে অনেক ৷
মেয়ের বাটির ভাতে খেয়াল নেই ৷ তবে বাটির সঙ্গে কথা বলে চলেছে মেয়ে -- হ্যাঁ হ্যাঁ বুড়ি মানুষ যখন পান তো খাবেই ৷ তা ওই পানের ডাব্বায় জাঁতি ছিল ? --যেটা দিয়ে অল্প মাংস কুচ কুচ কেটে অনেকটা কিমা বানানো যায় ? ---মেটেগুলো কুচো সুপুরি করে ফেলা যায় ! ছিল বাপ ?
বাপ দেখল -মেয়েটা দুই আঙ্গুল কাঁচির মতো করে চাঁদের নীচে ধরেছে ৷
ও মেয়ে কী কাটিস ? কাটছিস কী ?
চাঁদের আলো বাড়ছে ৷
গঞ্জের আলো জ্বললেও বোঝা যাচ্ছে না ৷
চাঁদের কলঙ্ক যেমন -অন্য আলো ঢেকে দেওয়ার মহিমাও তেমন !
ও বাপ .......!
Comments :0