কথা দিয়ে ছিল চা বাগান কর্তৃপক্ষ শুক্রবার, সোমবার বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দেবে। কিন্তু সোমবার বিকেল পর্যন্ত মজুরি না মেলায় মঙ্গলবার সকাল থেকে বিক্ষোভে শামিল হন ডুয়ার্সের মাল ব্লকের মানাবাড়ি চা বাগানের প্রায় ৭০০ শ্রমিক। বিক্ষোভরত শ্রমিকরা জানায়, গত ২২ ডিসেম্বর একটি মজুর দেওয়ার কথা ছিল তারপর গত ৯ জানুয়ারি আরো একটি পাক্ষিক মজুরি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষ মজুরি দিতে পারে নাই। পরপর দুটি পাক্ষিক মজুরি না পেয়ে গত শুক্রবার শ্রমিকরা সকাল থেকে কারখানা গেটের সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঘন্টা দুই বিক্ষোভ চলার পর ম্যানেজার কথা দিয়েছিল সোমবার অবশ্যই মজুরি দিয়ে দেবে। কিন্তু সোমবার শ্রমিকরা মজুরি পায়নি বাধ্য হয়ে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলার পর বাগান কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দেন আগামী শনিবার ১৮ জানুয়ারি একটি মজুরি অবশ্যই দেয়া হবে। ম্যানেজারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে শ্রমিকরা আবার কাজে যোগ দেয়।
চা বাগানের শ্রমিক বিষ্ণু ওরাও জানায়, এই চা বাগান কর্তৃপক্ষ গত কয়েক বছর যাবত ভালো ভাবে বাগান চালাচ্ছিল। কিন্তু, দুটি পাক্ষিক মজুরি কথামতো দিতে পারেনি। শ্রমিকদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এজন্যেই সবাই বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। চা বাগানের ম্যানেজার পবন ছেত্রী জানান, আর্থিকভাবে আমাদের কিছু সমস্যা চলছে তাই সময় মত মজুরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী ১৮ জানুয়ারি অবশ্যই একটি মজুরি দেওয়া হবে।
নতুন বছর শুরু হয়ে গেছে। দার্জিলিঙ পাহাড়ের লক্ষাধিক বাগিচা শ্রমিকদের ২০২৩—২৪ সালের উৎসব ভাতা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। রাজ্যের শাসকদল পুষ্ট চা বাগিচার মালিকদের চেহারা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চা শ্রমিকদের কাছে। বার বার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বাগান মালিকপক্ষ ও রাজ্য সরকার। যদিও বর্তমান রাজ্য সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতি ও সরকার মদতপুষ্ট মালিকপক্ষের মনোভাব সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল রাজ্যের পার্বত্য এলাকার চা বলয়ের শ্রমিকরা। ন্যায্য ও সম্মানজনক হারে বকেয়া বোনাস মিটিয়ে দেবার দাবিতে দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকার চা বাগানগুলোতে আছড়ে পড়ছে চা বাগিচা শ্রমিকদের বিক্ষোভ। কথা দিয়েছিলো রাজ্য সরকার নতুন বছরের আগেই বকেয়া বোনাসের টাকা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু বাগিচা শ্রমিকদের প্রতি সরকারি ঢিলেঢালা মনোভাবের দরুন বাগান মালিকরাও সুযোগ বুঝে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। মুনাফা লুটছে মালিকরা। আর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে চা বাগিচা শ্রমিকদের।
দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগানের শ্রমিকদের বোনাস মীমাংসায় গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে একটি দ্বিপাক্ষিক ও পরপর পাঁচটি ত্রিপাক্ষিক নিষ্ফল বৈঠক হয়। এরই মাঝে গত এক সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের শ্রমদপ্তর অগণতান্ত্রিকভাবে অ্যাডভাইসারি জারি করে পাহাড়ের শ্রমিকদের জন্য ১৬ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করে। জোর করে অসম্মানজনক বোনাস চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় শ্রমিকদের ওপর। অ্যাডভাইসারির বিরোধিতায় সমস্ত শ্রমজীবী অংশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে গর্জে উঠে প্রতিবাদ জানান। তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ও চা বাগান মালিকপক্ষের শ্রমিক বঞ্চনা নীতির প্রতিবাদে বাগানে বাগানে চলে কর্মবিরতি। পার্বত্য এলাকার সমস্ত বাগানের গেট ও ফ্যাক্টরির সামনে দিনরাত্রি ধরনায় বসেন পাহাড়ের বাগিচা শ্রমিকেরা। মুখ্যমন্ত্রীর শিলিগুড়ি থাকাকালীন সময়ে ১২ ঘণ্টার বন্ধে স্তব্ধ হয়ে যায় পাহাড়। তবুও মুখ্যমন্ত্রী বোনাস নিয়ে একটি শব্দও ব্যায় করেননি। ন্যায্য বোনাসের দাবিতে পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তায় চলেছে পথ অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি।
গোটা সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস জুড়ে বোনাস আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। পরবর্তীতে শারদোৎসব ও দীপাবলী উৎসব পেরিয়ে যাবার পরে গত ৬ নভেম্বর কলকাতার সভাতেও শ্রমিকদের বোনাসের কোন ফয়সলা হয়নি। ১৬ নভেম্বর ষষ্ঠ ত্রিপাক্ষিক বৈঠক থেকেও দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চলের চা বাগিচা শ্রমিকদের বোনাস চূড়ান্ত করা যায়নি। সেই বৈঠক থেকে সরকার ও মালিক প্রতিনিধিদের বোনাস মীমাংসায় আরো ১৫ দিন সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো চিয়াকামান মজদুর ইউনিয়ন সহ আটটি শ্রমিক সংগঠনের তরফে। কিন্তু ১৫ দিনের পরিবর্তে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। বকেয়া বোনাসের টাকা মেটানোর ক্ষেত্রে একেবারেই অনীহা প্রকাশ করে চলেছে বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ। সরকার ও মালিকপক্ষ যোগসাজসে লিপ্ত হয়ে টালবাহানার দরুন ২০২৩—২৪ আর্থিক বর্ষে উত্তরের দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকার বাগিচা শ্রমিকদের উৎসব বোনাসের পুরো টাকা মেটানো হলো না।
দল মত নির্বিশেষে পার্বত্য এলাকার প্রতিটি বাগানের প্রতিটি মহল্লার শ্রমিকদের এই সময়ের ঐক্যবদ্ধ দাবি একটাই ‘বকেয়া বোনাস চাই’। ২০ শতাংশ হারেই উৎসব ভাতা দিতে হবে। এই ন্যায্য দাবিতে সোচ্চার চা শ্রমিকরা। তবে মালিকপক্ষ এখনও শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিয়ে ১৩ শতাংশ বোনাস দিতেই অনড়। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে ১৬ শতাংশ বলা হয়েছে। সরকার ও মালিকের প্রবঞ্চনা ও ধোকাবাজির বিরুদ্ধে রাস্তার আন্দোলন রয়েছি আমরা। অবিলম্বে ২০২৩—২৪ সালের উৎসব ভাতা চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন সিআইটিইউ অনুমোদিত চিয়াকামান মজদুর ইউনিয়নের দার্জিলিঙ জেলা সভাপতি সমন পাঠক।
Tea Garden Workers
মজুরির দাবিতে চা বাগান শ্রমিকদের বিক্ষোভ
×
Comments :0