রামশঙ্কর চক্রবর্তী ও লক্ষীকান্ত সামন্ত: তমলুক ও হলদিয়া,
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলকে বিজেপি’র স্থানীয় বরাতপ্রাপ্ত দল হিসাবে উল্লেখ করে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, দুই দলের মধ্যে পুতুল নাচের নাটক চলছে, কিন্তু তৃণমূল আসলে বিজেপি’র লোকাল ফ্র্যাঞ্চাইজি, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তৃণমূলকে তৈরি করেছে আরএসএস। যতদিন রাজ্যে লাল ঝান্ডা শক্তিশালী ছিল ততদিন এরাজ্যে বিজেপি প্রবেশ করতে পারেনি, তৃণমূলের মাধ্যমে রাজ্যে বিস্তার লাভ করেছে বিজেপি-আরএসএস। দুই দলের মধ্যে ফারাক নেই এই সত্যটা সাধারণ মানুষ এখন ক্রমশ বুঝতে পারছেন বলে যেখানেই মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারছে সেখানেই তৃণমূল ও বিজেপি পরাজিত হচ্ছে।
সিপিআই(এম)’র পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির আহবানে রবিবার হলদিয়া ও তমলুক মহকুমার এরিয়া কমিটির সদস্য ও শাখা সম্পাদকদের নিয়ে দুটি সাধারণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার বিষয় ছিল "বর্তমান পরিস্থিতি এবং পঞ্চায়েত ও পৌর নির্বাচনে আমাদের কর্তব্য।" সভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন, আপসহীন সংগ্রাম করতে হবে লুটেরাদের পঞ্চায়েত থেকে হটাতে। খাতায় কলমে বিজেপি বিরোধী দল হলেও রাস্তায় লড়াইতে রয়েছে বামপন্থীরাই। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আরও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইকে তীব্র করতে হবে।
মানুষের পঞ্চায়েত তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এখন সেই পঞ্চায়েত থেকে মানুষকেই বাদ দিয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েতগুলি লুটের আখড়াতে পরিণত করেছে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এই পরিস্থিতির বদল ঘটানোর দায়িত্ব বামপন্থীদের।
এদিনের সাধারণ সভায় সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অনাদি সাহু, জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিও ভাষণ দেন। উপস্থিত ছিলেন পার্টি নেতা হিমাংশু দাস, ইব্রাহিম আলি, সুব্রত পন্ডা, মহাদেব মাইতি, সত্যরঞ্জন দাস, রীতা দত্ত, অমল কুইলা, পরিতোষ পট্টনায়েক, অচিন্ত্য শাসমল, চন্দ্রশেখর পাঁজা, শান্তনু দাস। হলদিয়ার শ্রমিক ভবনে সভা পরিচালনা করেন পরিতোষ পট্টনায়ক এবং তমলুকের কুলবেড়িয়া সুকুমার সেনগুপ্ত ভবনের সভায় সভাপতিত্ব করেন ইব্রাহিম আলি।
সভা দুটিতে মহম্মদ সেলিম বলেন "ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। ভূমিহীন কৃষকদের হাতে জমি দেওয়া হয়েছিল, অবৈতনিক শিক্ষা ও ব্যবস্থা, সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, নারী শিক্ষার মধ্য দিয়ে সাধারণ গরিব মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। এখন তৃণমূলের এগারো বছরে পঞ্চায়েত থেকে রাজ্য স্তর পর্যন্ত লুট চলছে। গরিব বর্গাদারদের জমি কেড়ে নিচ্ছে, আট হাজারেরও বেশি বিদ্যালয় বন্ধ করে দিচ্ছে, বালি, কয়লা, গোরু থেকে চাকরি, গৃহনির্মাণের টাকা, সবকিছু চুরি করছে। পঞ্চায়েতকে লুটমুক্ত করতে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে হবে।
মহম্মদ সেলিম বলেন, লাল ঝান্ডা খতম করতে দক্ষিণপন্থীরা একজোট হয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম তার একটি উদাহরণ। বিজেপি, তৃণমূল, মাওবাদী সহ সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি একজোট হয়েছিল, ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল নন্দীগ্রাম। ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যের সর্বত্র বামপন্থীদের ওপরে সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, মুখ বন্ধ করানোর চেষ্টা চলেছে। ২০১৮ সালের পর থেকে বিজেপি-কে এরাজ্যে বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরতে সক্রিয় ছিল মিডিয়ারও একাংশ। যে শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের হয়ে চুরি আর নারকীয় অত্যাচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনিই এখন বিজেপি’তে গিয়ে বড় বড় কথা বলছেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। এখন তৃণমূল দেখলেই সাধারণ মানুষ চোর দুর্নীতিগ্রস্ত বলছে, আর বিজেপি’কে দোসর বলছে।
সেলিম বলেন, সত্যিটা রাজ্যের মানুষ উপলব্ধি করছেন। সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফল তার বড় উদাহরণ। তৃণমূল সাগরদিঘিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেখানকার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে এই দুই শক্তিকে। তাই বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একত্রিত করতে হবে। প্রত্যেকটি বুথে মানুষের এই জোট তৈরি করে তৃণমূল ও বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইতে শামিল হতে হবে।
যে বিজেপি’র পক্ষে তৃণমূল ভূমিকা পালন করছে সেই বিজেপি’র বিপদ সম্পর্কে সেলিম বলেছেন, ধর্ম আগেও ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মকে যুক্ত করে এখন দেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে আরএসএস বিজেপি। দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, মানুষ কাজ হারাচ্ছে, কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ছে, সরকারি সম্পদকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতিবাদ ঠেকাতে ধর্মের নামে মানুষকে ভাগ করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে এরাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়কেই পরাস্ত করতে হবে।
সভায় অনাদি সাহু বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশের মানুষের ওপর আক্রমণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, বেকার বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার লুট করে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। জাতীয় সম্পদ লুট করছে আদানিরা। বিরোধীরা যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের জন্য প্রতিবাদ করছে, কিন্তু তাতে তৃণমূলের সাংসদরা নেই।
তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ৫২ বছর পরে শিক্ষক কর্মচারীরা সর্বাত্মক ধর্মঘট করল। ৫ এপ্রিল লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর জমায়েত করবেন দিল্লিতে। অধিকার বুঝে নিতে হাজির হবে তারা। এই অবস্থায় হলদিয়া পৌরসভা ও জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি কিংবা বিজেপি’র বিকল্প তৃণমূল, এই ভাবনাটা আত্মহত্যার শামিল। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লাল ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখার জন্য আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
নিরঞ্জন সিহি বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে বামপন্থীদের ওপর আস্থা বাড়ছে, আকাঙ্ক্ষাও বাড়ছে। মানুষের সেই আস্থার মর্যাদা দিতে হবে। তাদের পাশে নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে শামিল হতে হবে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সমস্ত বুথে প্রার্থী দিতে হবে, লড়াই করতে হবে।
Comments :0