Abhisekh Banarjee

যুবরাজ-রাজকুমারের ঘোষণার ফানুস

সম্পাদকীয় বিভাগ

চন্দন দাস

পিসি ভালো। খুব ভালো। ভাইপো কি আরও একটু বেশি ভালো? শুভেন্দু অধিকারীর মতো ভালো? নাকি কাঁথির মেজো রাজকুমারের থেকে কালীঘাটের যুবরাজ আরও ভালো?
খুব ধন্দ। মহাধন্দ।
পিসি কেন খুব ভালো? অনেক দৃষ্টান্ত। একটি সামান্য কিন্তু অনন্য উদাহরণ দিই। ২০১৯। ২৮আগস্ট। হুগলীতে প্রশাসনিক বৈঠকে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বলেছিলেন,‘‘দলের নামে টাকা তুললে গ্রেপ্তার করিয়ে দেব।’’ 
কী চমৎকার শুনতে লেগেছিল। আশারা পুলকিত হয়েছিল। হাজার হাজার তোলাবাজ গ্রেপ্তার হয়ে যাবে। পাড়ায় পাড়ায় লুটের টাকার বখরা নিয়ে তৃণমূলের খুনোখুনি বন্ধ হয়ে যাবে। হামলার জন্য মজুত বোমা ফেটে কোনও শিশুর নিহত হওয়ার আশঙ্কা মিলিয়ে যাবে। ‘তোলা’র কালো টাকার সমান্তরাল নিকষ অর্থনীতির অন্তর্জলি যাত্রা হবে। সরকারের কোষাগারে আরও টাকা জমা হবে। আমাদের ভালো হবে।
তারপর?


তিন বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। তৃণমূলের নেতারা তারপরও দেদার টাকা তুলেছেন। কাটমানি নিয়েছেন। যেখান থেকে পেরেছেন টাকা তুলেছেন তৃণমূলীরা। কয়লা, বালি পাচারের টাকা তো আছেই। প্রমাণ — বগটুই। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা অনুসারে কাজ হলে ভাদু শেখের তিনতলা বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার কথা নয়। জেলে ঘানি টানার কথা তার। তৃণমূলের সেই উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হলো গত মার্চে, ‘দলের নামে’ তোলা টাকার বখরা নিয়ে তৃণমূলের ভিতরে গোলমালে।
অর্থাৎ ‘দলের নামে টাকা’ তোলায় তৃণমূলের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মমতা ব্যানার্জি কথা রাখতে পারেননি। যতই আরএসএস’র ছকে তৈরি হোক, দলটির প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনিই। সেই তিনি জানেন — তৃণমূলে প্রায় সবাই তোলাবাজ। তাই ‘নো অ্যারেস্ট।’ 
কিন্তু চোখে ধুলো যদি দিতে হয় মমতা ব্যানার্জির মতই দিতে হবে। এই ক্ষমতা সবাই অর্জন করতে পারেন না। এ এক বিরল ‘গুণ।’ 
কিছুটা কি কাঁথির মেজো রাজকুমারের আছে? মিডিয়া তার একটি মাপকাঠি। নিঃসন্দেহে। শুভেন্দু অধিকারীর জন্য এত কালি, ফুটেজ খরচ কি এমনি এমনি? মোটেও নয়। বামপন্থীরা যখন গ্রাম উত্তাল করে দিচ্ছেন লুটের টাকা ফেরতের দাবিতে, মজুরি-কাজের দাবিতে, ঘরের তালিকায় ভুয়ো নাম বাতিলের আন্দোলনে, শহরে ভুয়ো ভোটারের নাম কাটার দাবিতে, তখন বিজেপি’র পরিষদীয় দলনেতা ‘তারিখ পে তারিখ’ দিচ্ছেন। কবে রাজ্যে বড় ঘটনা ঘটবে— এমন ভবিষ্যৎবাণী সাম্প্রতিককালে আর কেউ করতে পারেননি। রবিবার খবরের কাগজগুলির ক্রোড়পত্র যাদের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে থাকে, সেই তন্ত্রসাধক, কোষ্ঠীবিশারদ, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ‘রত্ন’রাও করতে পারেননি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার প্রাক্তন পরিবহণ, সেচ ও জলপথ মন্ত্রী করেছেন। এ আসলে রাজ্যে ক্রমশ প্রভাবহীন হয়ে পড়তে থাকা দলকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা।
দিলীপ ঘোষের মতো কয়েকজন ছাড়া শুভেন্দুর ঘোষণায় রাজ্যের প্রায় সবাই ছটফট করছি— কী হয়, কী হয়! তারই মধ্যে রানাঘাটে ভাইপোর উইং প্লে।


মমতা ব্যানার্জির পথেই অভিষেক ছুটছেন। শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর জোরদার দেখনদারির লড়াই, ঘোষণার যুদ্ধ। সব মিলিয়ে তিনজনের চোখে ধুলোর হিসাবি ঝড়— মানুষের জন্য।
যেমন, শনিবার রানাঘাটে অভিষেক ব্যানার্জি দাবি করে বসেছেন,‘‘আগামী পঞ্চায়েত ভোট অবাধ হবে। গণতান্ত্রিকভাবে হবে। এটা আমার গ্যারান্টি। জোর খাটালে দল থেকে বের করে দেব। এক ঘণ্টায় দল থেকে বার করব। দু’ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা হবে।’’ অর্থাৎ গ্রেপ্তার করাবেন।
সেই ভবিষ্যৎ— ঘোষণা, আশার আলোয় অতীত ভোলানোর চেষ্টা। অতীতের কোনও মূল্য নেই? ফলতার গত এগারো বছরের পরিস্থিতি ভুলে যেতে হবে? ভুলে যেতে হবে অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সেই ব্লকে বিরোধীদের কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি করার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে পুলিশ-তৃণমূলের? ভুলে যেতে হবে লোকসভা নির্বাচনের দিন ডায়মন্ডহারবারে সিপিআই(এম) প্রার্থী ডাঃ ফুয়াদ হালিমকে রক্তাক্ত করেছিল অভিষেক ব্যানার্জির কর্মীরা। আমাদের ভুলে যেতে ডায়মন্ডহারবারে গত এগারো বছরে পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা, লোকসভা— প্রতিটি নির্বাচনে তৃণমূলের নেতা, কর্মীরা দেদার বুথ দখল, ছাপ্পা দিয়েছে। 
অভিষেক ব্যানার্জির সেই লোকসভা এলাকা রাজ্যে ‘রিগিংয়ের মডেল।’ সেই মডেলে রাজ্যে তৈরি হয়েছে অনেক ফলতা, ডায়মন্ডহারবার।
তবু আসুন, সেই সব কিছু ভুলে যাই। কারণ— শুভেন্দুর ‘বড় ঘটনা’র পথ ধরে অভিষেক বলছেন — ‘নতুন বছরে নতুন তৃণমূল।’ পিসির ‘তোলা তুললে গ্রেপ্তার’ গিলেছি। ভাইপোর ‘রিগিং করলে আইনি ব্যবস্থা’ হজম হবে না? 


প্রশ্ন আছে। কারণ, ‘জোর খাটানো’র এক ঘণ্টা পরে অভিষেক ব্যবস্থা নিলে কী হবে? ততক্ষণে তো বুথ দখল, ভোট লুট হয়ে যাবে। তারপর ভোট লুটকারী তৃণমূলী দুষ্কৃতীকে দল থেকে বের করে দিলে কী লাভ? গণতন্ত্রের কী লাভ? আর তৃণমূল থেকে কাউকে বের করে দেওয়ার কোনও মানেই নেই। সিপিআই(এম)-এ বহিষ্কারের মানে আছে। এক-দু’জন তৃণমূল নেতা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তা জানেন। কিন্তু তৃণমূলে আবার বহিষ্কার কী? ফালতু। দু’দিন পরেই আবার সে দলে ঢুকে মানুষের টাকা লুট করতে শুরু করে দেবে।
‌অভিষেক বোধহয় জানেন। বোধহয় কেন? নিশ্চয়ই জানেন পরিস্থিতি। তিনি তাই সঙ্গে একটি ‘বর্তমান টোকেন কর্মসূচি’ রেখেছেন — ‘পদত্যাগ।’
শনিবার নদীয়ার রানাঘাটের সভায় তিনি এক প্রধানকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। অভিযোগ? চাকদহ ব্লকের তাতলা-১ পঞ্চায়েতের ওই প্রধান একটি পাড়ায় চার বছরে যাননি। অভিষেক ব্যানার্জি এদিন জনসভা থেকে বলেছেন,‘‘প্রধানকে বলব, কান খুলে শুনে রাখুন। মানুষ সার্টিফিকেট দিলে তবেই আপনি প্রধান। মানুষ সার্টিফিকেট না দিলে আপনি প্রধান নন। আগামী সোমবারের মধ্যে ইস্তফা দেবেন।’’
এই প্রধানের প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেল সেই পদে। আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এখন অভিষেক ব্যানার্জি বলছেন,‘‘মানুষ সার্টিফিকেট না দিলে আপনি প্রধান নন!’’ এতদিন অভিষেক ব্যানার্জি কী করছিলেন— প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এখন প্রধানকে সরানোর কোনও অর্থই হয় না। এমন কাণ্ড অভিষেক সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরে করেছেন। সেখানেও কাঁথি যাওয়ার পথে রাস্তায় নেমে একটি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে তিনি সামান্য ক্ষণ কথা বলেন। তারপর সভা মঞ্চ থেকে ওই মারিশদা পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান এবং ওই এলাকায় দলের নেতাকে পদত্যাগ করতে বলেন। 
তৃণমূলের প্রধান কতবার গ্রামে গেছেন, নাকি আদৌ যাননি— এটা এখন গ্রামের সমস্যাই নয়। রাজ্যের গ্রামগুলির প্রধান সমস্যা তৃণমূলের লুট। তোলা আদায়। কমিশন। কাটমানি। রেগার মজুরির ভাগ, গরিবকে ঠকিয়ে আবাস যোজনার টাকা নিয়ে নেওয়া থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত গ্রামবাসীদের জন্য বরাদ্দ ত্রিপল, চালও চুরি করে তৃণমূল। অভিষেক ব্যানার্জি দলের প্রধান, সদস্য, নেতাদের সেই লুট নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের পদত্যাগ করতেও তিনি বলছেন না। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে চুরি, মানুষ ঠকানোর অভিযোগ, তাদের কাউকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থীই করা হবে না— এমন ঘোষণাও করেননি।  


তাতে সমস্যা আছে। তৃণমূল প্রার্থী পাবে না। 
রেগার কাজ খতিয়ে দেখতে আসা কেন্দ্রীয় দল যে সামান্য ৪কোটি টাকা উদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছে, তাই গত প্রায় আড়াই মাসে তৃণমূলের নেতা, প্রধান, সদস্যদের কানমুলে উদ্ধার করতে পারেনি ‘সততার প্রতীক’-র সরকার। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ির তালিকায় বড়লোক তৃণমূলীদের নাম তুলেছেন যে প্রধান, উপপ্রধান কিংবা সদস্যরা— তাদের পদত্যাগের নির্দেশ যদি অভিষেক দিতেন, তাহলে বোঝা যেত সাহস আছে বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। কিন্তু ‘চোর’রা পদত্যাগ করুন তা ঘোষণা করা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর সাহসে কুলোয়নি।
অভিষেক তাই ক্ষমার মুখোশ পরে ফেলেছেন। রানাঘাটে বলেছেন, ‘‘আপনারা কথা দিন এখানে আমাদের শুধরানোর সুযোগ দেবেন। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করুন।’’
কী আশ্চর্য! প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা তাঁর। শপথ করার দায়িত্ব তাঁর। তিনি মানুষকে দিয়ে শপথ নেওয়াচ্ছেন — ‘ভুল শুধরানোর সুযোগ’ চেয়ে!
মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীই গত সাড়ে তিন বছরে একজন তোলাবাজকে গ্রেপ্তার করাতে পারেননি, সেই ব্যর্থতার জন্য ক্ষমাও চাননি। অভিষেক ব্যানার্জির ক্ষমা প্রার্থনা তাই মূল্যহীন। মানুষ ফুঁসছেন। প্রধান, উপপ্রধান, আধিকারিকদের তাড়া করছেন গ্রামবাসীরা। রেগায় কাজ নেই। বকেয়া মজুরি নেই। চুরির টাকা কোনও তৃণমূলী ফেরত দেননি। যোগ্যদের বাদ দিয়ে শিক্ষক-নিয়োগে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছে তৃণমূল নেতারা। মন্ত্রী জেলে। বিধায়ক জেলে। নেতা জেলে। অফিসাররা জেলে।


এই তৃণমূলের ক্ষমা চাওয়ার অধিকারই নেই। এ আসলে পারিবারিক সূত্রে নেতা হয়ে বসা যুবরাজের স্রেফ চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা। 
তৃণমূলকে ‘ক্ষমা’ মানে? আবার লুটের সুযোগ দেওয়া। লুটের জন্য তৃণমূলকে ভোট লুটে সুযোগ দেওয়া। আবার গ্রামে গ্রামে বোমাবাজি, হাঙ্গামার সুযোগ দেওয়া। 
‘ক্ষমা’ নেই এই লুট, চুরি, অত্যাচারের। 
 

Comments :0

Login to leave a comment