প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত বিরোধ নিয়ে এমনিতেই জেরবার অবস্থা ভারতের। এবার গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো দেশের অভ্যন্তরে রাজ্যগুলির মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। গত কয়েক বছরে উত্তর পূবরাঞ্চলে আসাম ও মেঘালয়, আসাম ও মণিপুর এবং আসাম ও নাগাল্যান্ডের সীমান্ত বিরোধ সংঠাত-সংঘর্ষের রূপ নেয়। অনেক রক্তপাত ও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের মধ্যে বহু পুরানো সীমান্ত বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। দুই রাজ্যের সীমান্তে বেলগাভি অঞ্চল কর্ণাটকের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বেলগাভি যেহেতু মারাঠি ভাষীদের সংখ্যাধিক্য তাই গোড়া থেকেই মহারাষ্ট্র বেলগাভিকে মহারাষ্ট্রে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে এসেছে। আজও মহারাষ্ট্র সেই দাবিতে অনড়। তেমনি কর্ণাটক কোনও অবস্থাতেই বেলগাভি ছাড়তে রাজি নয়। উলটে তারা মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ এলাকা কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি করে আসছে। দুই রাজ্যের এই সীমান্ত বিরোধ ক্রমশ অপ্রত্যাশিত সংঘাতের রাস্তা প্রশস্ত করছে এবং রাজ্যগুলির মধ্যে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং শান্তি ও সংহতি ধ্বংস করার অবস্থা তৈরি করছে। সবচেয়ে যেটা উদ্বেগের ও দুশ্চিন্তার সেটা হলো দু’রাজ্যেই রয়েছে বিজেপি-র সরকার। নরেন্দ্র মোদীর ভাষ্য অনুযায়ী ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। প্রশ্ন হলো কেন্দ্রে এবং দুই রাজ্যে বিজেপি-র সরকার থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত প্রশমিত না হয়ে ঘোরালো হচ্ছে কেন? কেনই বা দুই রাজ্যের একই দলের সরকার একে অন্যের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছে! কেন্দ্রীয় সরকারই বা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে কেন?
স্বাধীনতার পর স্বাধীন ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সীমানা নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার নেয়। ১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের মাধ্যমে সেই সমস্যার অবসান ঘটানো হয়। বেলগাবি তখনই কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়। আপত্তি করে মহারাষ্ট্র। ষাটের দশকে কমিশন গঠন করে মীমাংসার চেষ্টা হলেও সমাধান হয়নি। দীর্ঘকাল বিরোধ স্তিমিত থাকলেও ইদানীং নতুন করে তা চাগাড় দিয়ে উঠছে। উসকাচ্ছে দুই রাজ্যেরই সরকার। বিজেপি-র রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি বিভাজন। বিভাজনের রাজনীতি দিয় জল ঘোলা করে সাধারণ মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলি আড়াল করার এক ধরণের কৌশলি প্রয়াস স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সীমান্ত নিয়ে দুই রাজ্যকে সম্মুখ সমরে নামিয়ে দিয়ে প্রাদেশিকতায় আবেগ ভাসিয়ে দিলে মানুষ আর রুটি রুজি নিয়ে কথা বলবে না। বিজেপি তাদের সংকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে রাজ্যগুলির মধ্যে এইভাবে বিরোধ উসকে দিলে তার পরিণতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে। ভাষা মানুষের আত্মপরিচিতির অন্যতম উপাদান। ভাষাকে ঘিরে মানুষের আবেগ প্রশ্নাতীত। ভাষাভিত্তিক রাজ্য হবার ফলে রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীণ ঐক্য অত্যন্ত দৃঢ়। এই অবস্থায় গোটা দেশে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেবার মোদী সরকারের চেষ্টা নতুন বিপদের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এর ফলে অন্যভাষার মানুষের সঙ্গে হিন্দীভাষীদের মানসিক দূরত্ব কমতে পারে। তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে। তেমনি ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দুই রাজ্যের ভাষাই চালু থাকে। তখন সর্বত্র এই ধরনের বিরোধ দানা বাঁধতে পারে যদি না বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা না হয়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পর আর নতুন করে এমন বিরোধ বাঞ্ছনীয় নয়। বর্তমান সীমান্ত বজায় রেখে সব রাজ্য তাদের ভাষিক সংখ্যালঘুদের যথোপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে যাতে তাদের ভাষা-সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়।
Comments :0