SSC CORRUPTION

নতুন নিয়োগের নথি
সিএজি চাইলেও এড়িয়ে গিয়েছে এসএসসি

রাজ্য জেলা কলকাতা

SSC TET RECRUITMENT SCAM WEST BENGAL CAG BENGALI NEWS

২০০৬ সাল থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়ম ছিল নিয়োগ পরীক্ষার সব কাগজপত্র ফলাফল প্রকাশের পরেও অন্তত ৩ বছর সংরক্ষণ করে রাখার। কিন্তু তৃণমূল সরকার আসার পরে কার নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন সেটা কমিয়ে ৬ মাস করে দিয়েছিল? 

তদন্ত করতে গিয়ে অনিয়মের গন্ধ পেয়ে সিএজি নথি চাইলেই কেন তাদের বলা হয়েছে যে সব কাগজ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে? কেন পুরানো নিয়োগ পরীক্ষার নথি এগিয়ে দিয়ে সিএজি’কে বলা হয়েছে নতুন নিয়োগ পরীক্ষার নথি নেই? জেলবন্দি প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী সহ তৃণমূল নেতারা সিএজি রিপোর্টকে ঢাল করার চেষ্টা করতেই এই প্রশ্নগুলো আবার সামনে চলে এসেছে।


মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বলেছিলেন, বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের দুর্নীতির তদন্ত হবে। তারপরে?

কিছুই বের করতে না পেরে তিনি সাফাই গেয়ে বলেছেন, কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরে বলেছেন, সব ফাইল লোপাট। তারপরে আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, আলমারি লোপাট হয়ে গেছে। 

বাস্তবে সরকারি ফাইলের একটি কাগজও লোপাট হলে এফআইআর দায়ের করার কথা। রাজ্য সরকার সেই পথে হাঁটেনি। বরং স্কুল সার্ভিস কমিশনের কার্যপদ্ধতি নিয়ে রুটিন অডিট করতে নেমে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়ম ছিল নিয়োগ পরীক্ষার সব কাগজপত্র ফলাফল প্রকাশের পরেও অন্তত ৩ বছর সংরক্ষণ করে রাখার। কিন্তু পরে সেটা কমিয়ে ৬ মাস করে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে বহু ক্ষেত্রে নথির অভাবে সিএজি তদন্তই করতে পারেনি। 


২০০৯ সাল থেকে ‘ইন্টিগ্রেটেড অনলাইন একজামিনেশন সিস্টেম’র মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে স্কুল সার্ভিস কমিশন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই সিস্টেমের উপর অডিট করে দুর্নীতি ও বেনিয়মের চওড়া রাস্তার হদিশ পেয়েছিল সিএজি। কিন্তু তাদের তখনকার সতর্কবাণীতে তৃণমূল সরকার তো কান দেয়নি, বরং ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সিএজি যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে নবান্নে, একবছর সেই রিপোর্ট চেপে রেখে ২০১৯ সালের জুলাইতে তা প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার। 

অর্থাৎ বেনিয়মের রাস্তা বন্ধ করার বদলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সিএজি’র সেই রিপোর্টেই দেখা গিয়েছে, চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষা ব্যবস্থায় বড় রকমের গোলমাল রয়েছে এবং তা রয়েছে আঞ্চলিক দপ্তরগুলিতে নয়, একেবারে খোদ স্কুল সার্ভিস কমিশনের সদর দপ্তরে। এই পথেই পালটে দেওয়া হয়েছে প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর এমনকি জাতিগত পরিচয়ও, চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পিছনের জনকে এগিয়ে আনা এবং সামনের জনকে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এরকম নানা কায়দায়। 

এর পিছনে কত টাকার খেলা হয়েছে, কারা টাকা নিয়েছেন? এসবের উত্তর জানার জন্য সিএজি রাজ্য সরকারকে যে তদন্ত করতে বলেছিল তাতেও বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।


সিএজি’র ওই অডিটে দেখা যাচ্ছে, একাদশতম শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় অনেক প্রার্থীর অ্যাকাডেমিক স্কোর বাড়ানো হয়েছে, এমন প্রার্থীর হদিশ সিএজি পেয়েছিল যাদের ‘সিস্টেম ক্যালকুলেটেড পারসেন্টেজ অব অ্যাকাডেমিক মার্কস’র সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। এই কারচুরির উল্লেখ করে জবাব চাওয়া হয়েছিল সিএজি’র তরফে। 

সিএজি-কে সন্তুষ্ট করার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে ব্যাখ্যা পাঠানো হয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে। অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি কারচুপির অভিযোগ মেনে নিয়ে সেদিন তদন্ত করাননি, বরং ‘পদ্ধতির ব্যাখ্যা’ পাঠিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। ২০২৩ সালে এসে তৃণমূল নেতারা এখন সেই কারচুপির দায় বামফ্রন্ট সরকারের ওপরে চাপাতে পারে?


আসলে আরও বড় দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তাই অডিটের জন্য চাওয়া হলেও দ্বাদশতম শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার কোনও তথ্যই দেওয়া হয়নি সিএজি’কে। অর্থাৎ অডিটের জন্য এগিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরানো একাদশতম নিয়োগের নথি, কিন্তু নতুন দ্বাদশতম নিয়োগের নথি নেই বলে অডিট এড়ানো হয়েছে। 

সিএজি রিপোর্টে আক্ষেপ করে বলা হয়েছে, ভারত সরকারের রেকর্ড রিটেনশন সিডিউল ২০১২ অনুযায়ী সরকারি নথি ১০ বছর সংরক্ষণ করে রাখার কথা। ২০০৬ সাল থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনে তা ন্যূনতম ৩ বছরের করা হয়। দ্বাদশতম নিয়োগের এবং তার পরবর্তী নিয়োগের কোনো তথ্য না পাওয়ায় সেগুলির অডিট করা সম্ভব হয়নি।


সিএজি ২০১৭ সালের রিপোর্টেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিল সিস্টেমের স্বচ্ছতা নিয়ে। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আঞ্চলিক দপ্তর থেকে প্রাপ্ত নথির সঙ্গে সিস্টেমের তথ্য মিলছে না। অথচ গলদের উৎস খুঁজে বের করা যাচ্ছে না, কারণ আঞ্চলিক দপ্তরগুলির সঙ্গে কমিশনের সদর দপ্তরের ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটির ব্যবস্থাই করা হয়নি। অনলাইনে নয়, হাতে হাতে ব্যক্তির মাধ্যমে ফাইল পাঠানো হয়েছে সদর দপ্তরে, যেখানে তথ্যের কোনও নিরাপত্তাই নেই, যে কোনও সময়ে তথ্যকে বদলানো যেতে পারে।

তথ্য নিরাপত্তার অন্যতম শর্তই হলো কে কখন সিস্টেমে লগ ইন করেছে এবং কোন কোন ফাইলে কী পরিবর্তন করেছে তার বিস্তারিত সিস্টেমে পাওয়া যাবে। কিন্তু স্কুল সার্ভিস কমিশন এরকম কোনও লগ ইন করে তথ্য ব্যবহারকারীদের চিহ্নিতই করতে পারেনি, কারণ সেরকম ব্যবস্থাই নাকি নেই। 


যেখানে সিস্টেমে কোনও তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে অডিট করার জন্য চাকরি প্রার্থীদের কাগজপত্র পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্কুল সার্ভিস কমিশন কোনও কাগজপত্রই দেয়নি সিএজি-কে। এতদিন পরে আদালতের নির্দেশে সিবিআই ইডি তদন্তে যে দুর্নীতি প্রমাণিত হচ্ছে, সেই দুর্নীতি কী তখনই প্রকাশিত হয়ে যেতো যথাসময়ে সিএজি হাতে নিয়োগ পরীক্ষার কাগজপত্র পেলে? সেই কারণেই কি সিএজি অডিট এড়ানো হয়েছে?
 

Comments :0

Login to leave a comment