Editorial

কুম্ভ যখন জতুগৃহ

সম্পাদকীয় বিভাগ

ধর্ম বিশ্বাসীদের ধর্মমেলা যদি ধর্মান্ধ রাজনীতির কারবারিরা হাইজ্যাক করে নেয় তাহলে যেটা অনিবার্য সেটাই হয়েছে কুম্ভ মেলায়। বিপুল স্রোতের মতো ধেয়ে আসা জনস্রোতের পায়ের তলায় দলিত হয়ে প্রাণ হারালেন বহু মানুষ। জখম, আহতের সংখ্যা কয়েক শত। স্নানের মহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে এমন অনর্গল ঘোষণা মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে চলতে থাকলে লাখো মানুষের ঘাটমুখী স্রোত গিয়ে পিষে মেরে ফেলে সহ পুণ্যার্থীদের। পুণ্যলাভের তাড়নায় একাংশ এতটাই বেপরোয়া যে ফিরেও তাকায়নি পায়ের তলায় কে মরলো বা কে বাঁচলো। কোথায় পুলিশ! কোথায় নিরাপত্তারক্ষী! চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কেউ কারো নয়।
কুম্ভ মেলা নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যলাভের আশায় গঙ্গ-যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগে হাজির হন প্রতি ১২ বছর অন্তর মহাকুম্ভে। ছ’বছরের মাথায় হয় অর্ধকুম্ভ। এই সময় ভোরে সূর্যোদয়ের মুখে সঙ্গম স্থলে স্নান করলে নাকি পুণ্য লাভ হয় এবং মোক্ষলাভের রাস্তা প্রশস্ত হয়। এটাও অনেকের বিশ্বাস একবার কুম্ভ মেলায় গিয়ে স্নান করলে সব ধুয়ে মুছে নাকি নিষ্পাপ হওয়া যায়। এমন অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের তাড়নায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যেমন গঙ্গা সাগরে প্রতি বছর আসেন তেমনি কুম্ভ মেলাতেও যান। তবে আড়ে, বহরে যে কোনও স্নান মেলা থেকে কুম্ভই সবচেয়ে বড়। মূলত হিন্দিবলয় থেকেই মানুষ ভিড় করেন এই মেলায়। পুণ্যার্থীরা এটাও বিশ্বাস করেন অর্ধকুম্ভে স্নান করে যতটা পুণ্যার্জন করা যায় বা পাপস্খলন করা যায় তার থেকে অনেক বেশি প্রাপ্তি ঘটে পুর্ণকুম্ভে। আর মহাকুম্ভ হলে তো কথাই নেই।
এতকাল মহাকুম্ভ নিয়ে বিশেষ চর্চা ছিল না। এবারই যেন মাতামাতি চরমে পৌঁছে গেছে। আর সেটা ধর্মবিশ্বাসী পুণ্যার্থীদের থেকে হাজার গুণ বেশি মোদী-যোগী তথা কেন্দ্র ও উত্তর প্রদেশ সরকারের মধ্যে। কয়েক মাস ধরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মহাকুম্ভের প্রচার চালানো হয়েছে দেশজুড়ে। সরকারের পাশাপাশি গেরুয়া বাহিনীও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে। সরকার বারবার প্রচার করছে এবার নাকি ৪০ কোটি মানুষ মেলায় আসবে। কিন্তু একবারও যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে ভেরে দেখা হয়নি প্রয়াগে ৪০ কোটি মানুষের জায়গা আছে কি? এক কোটি মানুষ জড়ো হলেই গোটা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। এতদ্‌সত্ত্বেও মানুষের উন্মাদনা ছড়িয়ে ভিড় বাড়ানোর প্রয়াস চলে রাজনৈতিক স্বার্থে।
মোদী-যোগী জমানায় কুম্ভের ধর্মান্ধী মাহাত্ম্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। ব্যক্তিগত গণ্ডি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে ধর্মকে রাজনীতির আঙিনায় প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া প্রয়াস চলছে। তাই কুম্ভ মেলা হয়ে উঠেছে যোগী-মোদী উৎসবে। ধর্মের উজ্জীবনে এবং ধর্মকে রাজনীতির প্রধান অনুষঙ্গ করে ভোট রাজনীতির জমি উর্বর করতে যোগী সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। উত্তর প্রদেশে সরকারের এখন একটাই কাজ ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে গোটা দেশ থেকে মানুষ এনে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম করে দেওয়া। সেটা করতে গিয়ে নিরাপত্তা, সুব্যবস্থায় চরম অবহেলা করা হয়েছে। নিরীহ অসহায় মানুষের মৃত্যু তাঁরই পরিণতি।

Comments :0

Login to leave a comment