সদ্য নেওয়া হয়েছে, এমন সিদ্ধান্ত নয়। চার মাস আগেই ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে অভিযুক্ত ফেরার হিরে ব্যবসায়ী মেহুল চোকসির নাম। ২০২২ সালের নভেম্বরে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-কে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল ইন্টারপোলের তরফে।
কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে সিবিআই তা প্রকাশ্যে না এনে চেপে রেখে দিয়েছিল। এখন সংবাদ মাধ্যমে ইন্টারপোলের পদক্ষেপ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিরোধী দলগুলির কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে সিবিআই কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। সোমবার ওই পদক্ষেপের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার জেরে মঙ্গলবার সিবিআই চার মাসের নীরবতা ভেঙে এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকা থেকে মেহুলের নাম সরিয়ে দেওয়া হলেও ফেরার ওই হিরে ব্যবসায়ীকে ভারতে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় কোনও বাধা তৈরি হয়নি।
সেই সঙ্গেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের যে বিভাগ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই কমিশন ফর কন্ট্রোল অব ইন্টারপোল’স ফাইলস (সিসিএফ)-কে রেড নোটিশের তালিকায় মেহুল চোকসির নাম পুনরায় যুক্ত করতেও আরজি জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা শোধ না করে ২০১৮ সালে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন গুজরাটের হিরে ব্যবসায়ী মেহুল চোকসি, সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যাকে ‘মেহুল ভাই’ বলে সম্বোধন করতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তিনি আশ্রয় নেন অ্যান্টিগুয়া-বারবুদায়।
পরে জানা যায়, পালিয়ে যাওয়ার এক বছর আগেই ২০১৭ সালে তিনি ওই দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, ভারত সরকার (মোদী সরকার) কি তা জানত না! ভারতীয় সংবিধান যেহেতু দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করে না, তাই এদেশের কাউকে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিতে গেলে ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়। যিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের থেকে বিপুল টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করেননি, তাকে ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়ার অনুমতি সরকার দিল কেন?
এই সব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য যথারীতি জানা যায়নি। তবে নানা মহলের প্রবল চাপে পড়ে সরকার মেহুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। মেহুলের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ২০১৮ সালেই সিবিআই’র আরজিতে সাড়া দিয়ে ১৯৫টি দেশের পুলিশবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ বা ইন্টারপোল রেড নোটিশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এই হিরে ব্যবসায়ীর নাম। এরপর ২০২০ সালে মেহুল ওই তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার আরজি জানান ইন্টারপোলের সিসিএফ’র কাছে, তাও প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে ২০২২ সালে সিসিএফ’র কাছে তিনি ফের একই আবেদন জানান এবং এবার তা গ্রাহ্য হয়।
এই সিসিএফ ইন্টারপোলের একটি বিভাগ হলেও প্রতিষ্ঠানের সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। একটি স্বশাসিত বিভাগের মতো এটি কাজ করে। বিভিন্ন দেশের থেকে নির্বাচিত আইনজীবীদের নিয়ে সিসিএফ গঠিত। ইন্টারপোল কোনও ব্যক্তিকে ফেরার বলে ঘোষণা করলে তিনি সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে পারেন সিসিএফ’র কাছে, যেমন জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর ‘মেহুল ভাই’।
অন্যদিকে, রেড নোটিশ হলো ইন্টারপোলের তরফে কোনও পলাতক অপরাধীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতার বার্তা। কারও বিরুদ্ধে এই নোটিশ জারি করার অর্থ, ইন্টারপোলের সদস্য সব দেশই তাকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চালাবে। গ্রেপ্তার হলে যে দেশ তাকে খুঁজছে, সেই দেশে প্রত্যর্পণের আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এদিন সিবিআই’র বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, রেড নোটিশের তালিকা থেকে মেহুলের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন পাওয়ার পরে সিসিএফ নিয়ম মতো তাদের মতামত জানতে চেয়েছিল। তারা জানিয়ে দিয়েছিল, ভারতে প্রত্যর্পণ ও আইনি বিচার এড়ানোর জন্য সমস্ত রকম চেষ্টা চালাচ্ছেন মেহুল। এই আবেদনে যেন গ্রাহ্য করা না হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু কাল্পনিক ধারণা ও অপ্রমাণিত অনুমানের ভিত্তিতে ৫ সদস্যের সিসিএফ রেড নোটিশের তালিকা থেকে মেহুলের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২২ সালের নভেম্বরে।
সিবিআই আরও দাবি করেছে, সিসিএফ-কে তারা জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে পদ্ধতি, করা হয়েছে ভুল। রেড নোটিশের তালিকা থেকে মেহুলের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংশোধনের জন্য ইন্টারপোলের কাঠামোর মধ্যে সমস্ত চেষ্টাও করছে তারা। শুধু চার মাস ধরে সিবিআই বিষয়টি গোপন কেন রেখেছে, তার কোনও উত্তর নেই এই বিবৃতিতে।
বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, মেহুল চোকসি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে ছিলেন, তা সবার জানা। এমনিতেই মেহুল বিদেশে পালিয়ে যেতে সমর্থ হওয়ায় মোদী সরকারের মুখ পুড়েছে। এবার মোদী সরকারকে আরও অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতেই ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকা থেকে মেহুলের নাম বাদ দেওয়ার খবর সিবিআই চেপে গিয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই তা করা হয়েছে। কারণ, সিবিআই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন।
বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকারকে তীব্র কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস। দলের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী মঙ্গলবার টুইটে বলেছেন, ‘বিপক্স কো ইডি-সিবিআই, মিত্র কো রিহাই’ (বিপক্ষের জন্য ইডি-সিবিআই, বন্ধুদের ছাড়)। তিনি টুইটারে আরও লিখেছেন, ‘মোদানি মডেল মতলব পহেলে লুটো, ফির বিন সাজা কে ছুটো’ (মোদানি মডেলের অর্থ, প্রথমে লুট করো আর তারপর বিনা সাজায় পালিয়ে যাও)।
বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও এদিন সংসদ থেকে বেরনোর সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। দেশের ব্যাঙ্ক থেকে মেহুল চোকসির মতো লোকরা সেই অর্থ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন। এমন লোকদের যাঁরা সুরক্ষা দিচ্ছেন, তাঁরাই আবার দেশাত্মবোধের কথা বলছেন। এটা মসকরা ছাড়া আর কিছু নয়। স্পষ্টতই ‘না খানে দুঙ্গা’ এই সরকারের আরেকটা ‘জুমলা’।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে টুইটে তিনি বলেন, ‘‘বিরোধী নেতাদের জন্য রয়েছে ইডি-সিবিআই, কিন্তু মোদীজীর ‘আমাদের মেহুল ভাই’য়ের জন্য আছে ইন্টারপোলের হাত থেকে মুক্তি। ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’-এর জন্য (ইঙ্গিত মোদী-ঘনিষ্ঠ আদানিকে) যদি সংসদ অচল করে দেওয়া যায়, তাহলে ৫ বছর আগে পালিয়ে যাওয়া ‘ওল্ড ফ্রেন্ড’-কে সাহায্য না করে কীভাবে থাকা যায়!’’
Comments :0