রবিবার সকাল থেকে বিশ্বকাপ ফাইনালের সাক্ষী থাকার জন্য প্রস্তুত ছিলেন প্যারিসের মানুষ। প্রশাসনের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, আজ শঁজেলিঁজে চত্বরে কোনও গাড়ি চলবে না। গোলমাল আটকাতে মোতায়েন করা হয়েছিল প্রায় ২৭০০ পুলিশ। তার উপরে জাঁকিয়ে পড়েছিলো ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাসের নিচে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষের। কিছুটা গাড়িতে, বাকিটা পায়ে হেঁটেই পাবলিক স্টেডিয়ামগুলোয় ভিড় জমিয়েছিল মানুষ। প্রশাসনের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল, পাবলিক স্টেডিয়ামগুলিতে জায়ান্ট স্ক্রিন লাগিয়ে ম্যাচ দেখার ব্যবস্থা করা হবে। সেই রকমই ব্যবস্থাও ছিল।
এ বারের বিশ্বকাপ হয়তো জিততে পারল না ফ্রান্স, কিন্তু সাধারণ মানুষের মন জিতে নিয়ে হৃদয়ের নায়ক হয়ে থেকে গেলেন এমবাপে। মেসি রোনাল্ডো যুগের উত্তরসূরি যে তিনিই। ব্যক্তিগত নিপুণ কৌশল দেখিয়েও ফুটবলের কুরুক্ষেত্রে হার মানতে হয়েছে কিলিয়ান এমবাপেকে। বিশ্বকাপ ফুটবলের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার কাছে পরাস্ত হওয়ার পর দৃশ্যতই ভেঙে পড়েন ফরাসি দশ নম্বর। আর্জেন্টিনীয় ফুটবলাররা যখন জয়ের উৎসবে শামিল, তখন মাঠে বসে পড়তে দেখা যায় এমবাপেকে। আর সে সময়ই কালো স্যুট-টাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরেঁর হাত সান্ত্বনা স্বরূপ মাথায় নেমে আসে। যিনি দর্শকাসনে বসে জাতীয় দলকে সমর্থন জুগিয়ে যান, আশাহত ফুটবলারদের সান্ত্বনা দিতে নেমে আসেন মাঠে। দেশের অন্যতম সেরা ফুটবল ‘রত্ন’কে কার্যত অভিভাবকের মতো বোঝাতে দেখা যায় তাঁকে। শুধু এক বার নয়, বারবার। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও ফরাসি দলের খেলোয়াড়দের আলিঙ্গন করে তাঁদের প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন মাকরঁ। বলেন, “ছেলেরা, তোমাদের জন্য আমি গর্বিত।”
বিশেষত কাতার বিশ্বকাপে উল্কার গতিতে ছুটলেন কিলিয়ান এমবাপে। নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপেই ১২ গোল করে ফেলেছেন তিনি। তাঁর সামনে রয়েছেন আর মাত্র পাঁচজন। যে গতিতে এমবাপে এগচ্ছেন তাতে হয়তো পরের বিশ্বকাপেই সবাইকে ছাপিয়ে যাবেন তিনি। হবেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে প্রথম বার খেলতে নেমে চারটি গোল করেছিলেন এমবাপে। এ বার তিনি করেছেন ৮টি গোল। বিশ্বকাপে গোলদাতাদের তালিকায় পেলের সঙ্গে যুগ্মভাবে পঞ্চম স্থানে রয়েছেন তিনি। তাঁর ঠিক উপরেই রয়েছেন লিয়োনেল মেসি ও ফ্রান্সেরই জাঁ ফঁতে। তাঁদের গোল সংখ্যা ১৩। জার্মানির গার্ড মুলারের রয়েছে ১৪টি গোল। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন ব্রাজিলেন রোনাল্ডো নাজারিয়ো। তিনি ১৫টি গোল করেছেন। শীর্ষে জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোজে। তাঁর গোলের সংখ্যা ১৬টি। পরের বিশ্বকাপে আর পাঁচটি গোল করলেই ক্লোজের নজির ভেঙে দেবেন এমবাপে। তাঁর বয়স এখন মাত্র ২৩। এখনও অন্তত তিনটি বিশ্বকাপ খেলবেন তিনি। যে ভাবে হাসতে হাসতে তিনি গোল করছেন তাতে কোথায় গিয়ে থামবেন কে জানে।
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এমবাপে। গত বার বিশ্বকাপের ফাইনালে করছিলেন একটি গোল। দেশ জিতেছিল বিশ্বকাপ। এ বারের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পরে দ্বিতীয় বার কোনও ফুটবলার ফাইনালে এই কীর্তি করলেন। দ্বিতীয়ার্ধে দুরন্ত ফুটবল খেললেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে মাঠ ছাড়তে হলো এমবাপেকে। খেলার জন্য নায়কের মর্যাদা পেলেও বিশ্বকাপ জেতা হলো না। এ বারের বিশ্বকাপে ৮ গোল করে সোনার বুট এমবাপের দখলে। কিন্তু তার পরেও চোখের জলে মাঠ ছাড়লেন তিনি। তবে যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিলেন, আগামী দিনে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে একাই দাপিয়ে বেড়াবেন এই ফরাসি স্ট্রাইকার। নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপেই বিশ্বের সেরাদের তালিকায় ঢুকে পড়লেন এমবাপে।
২০২২সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল দেখল দুই ফুটবল তারকার লড়াই। স্বাভাবিক নিয়মেই এক তারকা জিতলেন, আর এক তারকা হারলেন। গত বারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এ বারে কাপ জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছেও পরাজিত হওয়ায় হতাশা গোপন করেননি ফরাসি ফুটবলাররা। এমবাপের একক কৃতিত্বেই আর্জেন্টিনার সঙ্গে টক্কর নিচ্ছিল ফ্রান্স। ফাইনালে পেনাল্টি সহ ৩টি গোল ১৯৬৬ সালের রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন তিনি। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোল করায় পেয়েছেন সোনার বুটও। কিন্তু এ বারের মতো অধরা থেকে গিয়েছে কাপ। রবিবার রাতের ফাইনালের পর ফরসি কোচ দেশঁ এমবাপের বিষয়ে বলেন, “কিলিয়ান সত্যিই এই ফাইনালে তার ছাপ রেখে গেছেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনি যেভাবে পছন্দ করতেন সেভাবে শেষ করতে পারেননি এবং সে কারণেই তিনি সব খেলোয়াড়ের মতো ম্যাচ শেষে হতাশ হয়েছিলেন।’’
ফাইনালের পর যথারীতি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হননি এমবাপে। তবে ম্যাচের প্রায় ১৭ ঘণ্টা পরে তিনটি শব্দে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি। সমাজমাধ্যমে এমবাপে লিখেছেন, “আমরা ফিরে আসব।” ২০১৮-য় রাশিয়া বিশ্বকাপে ১৯ বছর বয়সেই ট্রফির স্বাদ পেয়েছিলেন এমবাপে। এ বারও প্রায় একার হাতে দলকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। অল্পের জন্য কাপ এবং ঠোঁটের দূরত্ব রয়ে গিয়েছে। এমবাপের এই বার্তায় অনেকেই মনে করছেন, আগামী বছর আবার বিশ্বকাপের জন্য নতুন উদ্যমে ঝাঁপাবেন এমবাপে।
Comments :0