হোয়াইট হাউস দখলের লড়াইয়ে আর বাকি ৪৮ ঘণ্টা। প্রচার শেষের আগে আমেরিকার তথাকথিত ‘সুইং স্টেট’-গুলিতে লাগাতার প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস। এই সমস্ত প্রদেশে প্রতিবারেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তুঙ্গে ওঠে। শেষপর্যন্ত যিনি বাজিমাত করতে পারেন, তাঁরই জোটে রাষ্ট্রপতির কুর্সি। আগাম ভোটপর্বে ইতিমধ্যে ভোট দিয়ে ফেলেছেন অন্তত সাড়ে সাত কোটি মার্কিন ভোটার। আপাতত প্রাপ্ত তথ্য, কোনও প্রার্থীই এই প্রদেশেগুলিতে তিন শতাংশ হারের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে নেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে শনিবারের হিসেব অনুযায়ী, আইওয়া প্রদেশে সামান্য শতাংশে এগিয়ে গিয়েছেন হ্যারিস। গতবারে এখানে জিতেছিলেন ট্রাম্প। এবারেও এমনটাই হবে বলে মনে করেছিলেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। সারা দেশের হিসেবে শনিবার পর্যন্ত ১.৩ শতাংশ হারে ট্রাম্পের থেকে এগিয়ে হ্যারিস। ভোটের অঙ্ক সার্বিকভাবেই এমন অস্থিতিশীল হওয়ায় বাড়ছে চাপানউতোর। এই অবস্থায় ভোটের চূড়ান্ত ফলপ্রকাশে বেশ কয়েকদিন লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই সক্রিয়তা বাড়ছে বিভিন্ন বড় শহরের নির্বাচন দপ্তরের অফিসে। শনিবারেই নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়ে স্ট্রিটের নির্বাচন দপ্তরের অধ্যক্ষ মাইকেল রায়ান জানিয়েছেন, ‘‘আগাম ভোটপর্বের প্রথম দিনেই প্রায় দেড় লক্ষ ভোট পড়েছে। এটা নজিরবিহীন। এতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে আমাদের সবারই এতে উৎসাহ অনেকটাই বেড়েছে।’’ ভোটের দিনের ভিড় এড়াতে মার্কিন মুলুকে নাগরিকদের জন্য আগাম ভোটদানের সুযোগ রয়েছে। রায়ান বলেন, ‘‘এই শহরে আগের বার ১০০টি ভোটকেন্দ্র তৈরি করা হয়। তবে এবারে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা অন্তত ৫০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।’’ নিউ ইয়র্কের জন জে কলেজের ভোটকেন্দ্রে শনিবারে ভোটারদের ভিড় রীতিমতো নজর কাড়ে। এই কেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর সুজান জানান, ‘‘সকাল থেকেই আমরা ব্যস্ত। সবাইকে প্রয়োজনমতো সহযোগিতা করছি। এই সময়কাল দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে এগিয়ে এসে ভোট দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে হবে।’’
মিশিগানের তথাকথিত ‘রাস্ট-বেল্ট’-কে পাখির চোখ করে, শনিবার থেকে প্রচার চালাচ্ছেন হ্যারিস। একদা ইস্পাত শিল্প প্রধান এই এলাকা এখন রীতিমতো ধুঁকছে। বেকারি, ছাঁটাই, অপরাধমূলক কাজের মতো সমস্যার সম্মুখীন এখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের বড় অংশ। অন্যদিকে পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ার শিল্প প্রধান এলাকাগুলিতে প্রচার চালাচ্ছেন ট্রাম্প। দুই প্রার্থীরই ভোটের ঝুলিতে এই সমস্ত অঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক মন্দা, উৎপাদনে ঘাটতি ও ছাঁটাইয়ের মতো বিবিধ সমস্যায় ভুগছেন এই সমস্ত শিল্প প্রধান অঞ্চলের সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ।
এদিকে মিশিগানের প্রচারে এই প্রদেশের প্রায় দুই লক্ষ আরব অভিবাসীদের থেকে বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছেন হ্যারিস। তাদের বক্তব্য, ‘‘ট্রাম্প আমাদের দেশছাড়া করতে চায় ঠিকই। তবে উলটো দিকে এক বছর ধরে গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তা বন্ধ করতে হ্যারিস একেবারেই কোনও ভূমিকা নেননি।’’ বহু বছর ধরেই মার্কিন মুলুকের আরব অভিবাসীরা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে এসেছেন। তবে বাইডেন-হ্যারিসের শাসনকালে ইজরায়েলের গাজা ও দক্ষিণ লেবাননে ইজরায়েলের নৃশংস গণহত্যার বিষয়ে আমেরিকা কোনও ভূমিকা না নেওয়ায় অসন্তোষ বেড়েছে তাঁদের মধ্যে।
শেষ কয়েক দিনে নির্বাচনী মঞ্চের ভাষণে ট্রাম্পের বিভাজনমূলক নীতির বিরুদ্ধেই কামান দেগেছেন হ্যারিস। ‘‘গত এক দশক ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্প লাগাতার আমাদের মধ্যে বিভাজন ও হিংসার বীজ বপণ করার চেষ্টা করেছেন। এবারের ভোটে তার সমস্ত রকম চক্রান্ত চিরকালের জন্য খতম করার সুযোগ রয়েছে,’’ বলেছেন তিনি। অন্যদিকে, মন্দা আর অভিবাসন বিরোধিতাকেই হাতিয়ার করে প্রচার চালাচ্ছেন ট্রাম্প। এই সপ্তাহের শেষে পেনসিলভানিয়ার লিটিৎজ শহরে প্রচার চালিয়ে নর্থ ক্যারোলিনার কিংস্টন এবং তারপর জর্জিয়ার ম্যাকন পৌঁছবেন রিপাবলিকান প্রার্থী। বিশেষজ্ঞদের মত, ভোটের আগে এই সমস্ত প্রদেশের রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ গ্রামীণ ভোটারদের একজোট করতে মরিয়া ট্রাম্প।
গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে প্রচারে পিছিয়ে নেই হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটরাও। বাইডেন-হ্যারিস জামানায় কৃষকদের রাষ্ট্রীয় অনুদান অনেকটাই বেড়েছে। এতে বেশ খুশি আমেরিকার ছোট কৃষকদের একটা বড় অংশ। এবারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের অনুদান বাড়ানোর কথা বলেছে ডেমোক্র্যাটরা। এতে বেশ উৎসাহী জর্জিয়ার পিচ কাউন্টির বহু কৃষক পরিবার। চলতি মন্দার কারণে এই প্রদেশের কৃষকরা নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি। গত বারের ভোটে ট্রাম্প এই অঞ্চলে অল্পের জন্য জেতেন। এবারেও এখানে প্রচারে ব্যাপক জোর দিয়েছেন যুযুধান দুই পক্ষ। এই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরা সংখ্যায় বেশি হওয়া কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছেন হ্যারিস। মার্কিন মুলুকের দক্ষিণের অন্যান্য প্রদেশের মতোই জর্জিয়ার গ্রামীণ ভোটাররাও জাতিগত পক্ষপাতের ভিত্তিতে ভোট দিয়ে থাকেন। বহু দশক ধরেই এখানকার কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেন। উলটো দিকে শ্বেতাঙ্গদের ভোট পান রিপাবলিকানরা। তবে এতেও কিছু প্রজন্মগত তফাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যাঁরা কমবয়সী, গর্ভপাত সহ নানা বিষয় নিয়েই তাঁরা ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের প্রতি ক্ষুব্ধ।
Comments :0