শুভজিৎ সরকার
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ মানে আসলেই এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করা। স্কুলের ইউনিফর্ম থেকে নির্দিষ্ট ইউনিফর্মের বাইরে গিয়ে নতুন এক পৃথিবীতে পথ চলা শুরু। প্রতিটা ছাত্র দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে কবে কলেজ যাবে। এমনি সংখ্যার দিক থেকে এগারো ক্লাসের পর বারো ক্লাস এলেও কলেজের ফার্স্ট ইয়ার যেন বারো ক্লাসের পরে আরও অনেকগুলো ক্লাস পার করে নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করা। স্কুলে যেমন আমাদের মধ্যে চিন্তা, চেতনার উদ্ভব হয়, তেমনই কলেজ সেই চিন্তা, চেতনাগুলোকে শাণিত করে। মতাদর্শের বোঝাপড়া তৈরির অধ্যায় এই কলেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়টা। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার এক একটি পীঠস্থান এবং সমাজকে ভাবার, বদলানোরও কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং কলেজও শাসক শ্রেণির রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার কাজ করেছে এবং করবে আগামীতেও। শাসকের ভুল ধরা থেকে শুরু করে, শাসক বদলানোর মাটি তৈরির কাজও করেছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সর্বদা যে কাজ করে গেছে তা হল, শাসক শ্রেণির সমাজ নিয়ে যে গতানুগতিক ভাবনা তার বিরুদ্ধে নতুন ন্যারেটিভ তৈরির কাজ। খুব কম শাসকই আছে যারা চেয়েছে আক্ষরিক অর্থে উচ্চ শিক্ষার উন্নতি হোক বা এর বীজ আরও সাধারণের মধ্যে ত্বরান্বিত হোক। কেবলই চাকরির জন্য পড়াশোনা করা নয় বরং অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার পাশাপশি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা— এমন ধারণা পোষণ করেছে সমাজের অল্প কিছু শাসক। যদিও এই ধরনের শাসকেরা নিজেদের শাসক বলতে অপছন্দ করছে এবং তারা বলেছে তারা মানুষের দেওয়া দায়িত্ব সামলেছে। স্কুল যে প্রাথমিক ধারণা তৈরির কাজ করে সেই ধারণাই বাস্তবিকভাবে দেখা যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার সময়। আসলে এই ক্যাম্পাস বিষয়টাই আমাদের জীবনে এক কম্পাসের মতো যা প্রতিনিয়ত আমাদের দিক নির্দেশ করে। সেই জন্যই এই ক্যাম্পাসের উপরেই প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের আক্রমণ তেজ এতটা তীব্র।
বারো ক্লাসের বোর্ডের রেজাল্ট বেরোনোর পর কলেজের ফর্ম ফিলাপ করে সেখানে ভর্তি হওয়া এটাই এত বছর বা এতগুলো যুগ ধরে স্বাভাবিক ছিল। প্রশ্ন উঠবে, ছিল কেন বলছি! এখন কি নেই?
সাম্প্রতিককালে আমরা বিরাট এক সমস্যার সম্মুখীন। রাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি ছাত্র-ছাত্রীরা বোর্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও কলেজের ফর্ম ফিলাপ করতে পারছে না। কারণ, রাজ্যের বর্তমান যে সরকার তারা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গন্ডগোল পাকিয়ে রেখেছে। ২০০৯ এর পরবর্তী সময়ে রাজ্যের ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করেছে কোর্ট। বিচার চলছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে রাজ্যের সদ্য স্কুল পেরনো ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে অ্যাডমিশনের জন্য গত এক মাস ধরে যারা অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে। মে মাসে রেজাল্ট বেরোনোর পর একটা মাস কেটে গেছে কিন্তু প্রতিবছর যখন ছাত্র-ছাত্রীরা কোন কলেজে ভর্তি হবে বা অনেক ক্ষেত্রে একাধিক জায়গায় ভর্তি হয়ে কোথায় পড়বে আর কোথায় কোথায় অ্যাডমিশন ক্যান্সেল করবে এই ধারণা রাখতো, সেখানে অনেকে এই ভয়ে আছে যে তাদের কি বছরটা নষ্ট হবে!!
পশ্চিমবাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির যে পরিবেশ সেটা আপাদমস্তক তৃণমূলের ভক্তও স্বীকার করে নেবে। এই রাজ্যে শাসক দল শিক্ষাকে বাজারে আলু, পটলের মতো বিক্রি করেছে সেটা জলের মতো পরিষ্কার। কলেজে অ্যাডমিশনে তোলাবাজির অভিযোগ উঠবে এটাই স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে গত এক দশকের বাংলায়। কিন্তু এবার আরেকটা চিন্তা, যে অ্যাডমিশনটা আদৌ হবে কি না। আশপাশের রাজ্যেও মানুষ যে খুব ভালো আছে এমন নয়, কিন্তু সার্টিফিকেট নিয়ে এরকম ধরনের জটিলতার পরিবেশ ওখানে তৈরি হয়নি বলে অনেকেই আশপাশের রাজ্যে পড়তে চলে যাচ্ছে। যাদের পয়সা আছে তারা বাইরের রাজ্যের কলেজে ফর্ম ফিলাপ করছে, এই রাজ্যের মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশন নেওয়া বেসরকারি কলেজে ফর্ম তুলছে। কিন্তু সমস্যায় গরিব, সাধারণ নিম্নবিত-মধ্যবিত্ত মানুষ, দিন আনি দিন খাওয়া মানুষের সন্তানরা। যাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক এবার ভালো রেজাল্ট করেছে, সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এগুলোই তাদের বড় হয়ে ওঠার একমাত্র জায়গা। সেগুলো আজ ভয়ানক ক্রাইসিসের মধ্যে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন প্রাথমিক শিক্ষা হোক বা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে রাজ্যের সরকারে থাকা শাসকের এই হেলাফেলা করা আসলেই হয়তো পরিকল্পিত। বেসরকারি শিক্ষাকে সিলমোহর দিয়ে সরকারি অবৈতনিক শিক্ষা তুলে দেওয়াটা অ্যা জেন্ডা। এর পাশাপশি শিক্ষা থেকে অনীহা তৈরি এক পরিস্থিতি রূপ নেবে যার জন্য অনেকেই আর উচ্চশিক্ষার পরিসরে যেতে চাইবে না। বিগত বেশ কিছু বছরের কলেজের ভর্তির তথ্য বলছে এই রাজ্যের নামি সরকারি ডিগ্রি কলেজগুলোর সিট ফাঁকা থেকেছে। যে কলেজগুলোতে প্রায় ৮-১০ বছর আগেও ফর্ম তোলার জন্য বিরাট প্রতিযোগিতা চলতো, ভর্তির পরীক্ষা দিত লক্ষের কাছাকাছি ছাত্র-ছাত্রীরা, সেই কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়েও সিট ফাঁকা থেকেছে। অত্যন্ত চিন্তার বিষয় যে এভাবে পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামীতে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ আরও কমবে। স্কলারশিপের টাকা বন্ধ বহু মাস ধরে, গরিব ঘরের বা অন্যান্য মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। গ্রাম বা শহর বলে নয়, রাজ্যের সর্বত্র শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার থেকে ঠুনকো এক পণ্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজ্যের সরকার। ধীরে ধীরে লেখাপড়া তুলে দেওয়ার এক ভয়ানক ব্লুপ্রিন্ট। যারা এরপরেও পড়ার জন্য আগ্রহী তাদের এবার ভরসার জায়গা হবে কেবলই বেসরকারি শিক্ষা। এই বেসরকারি কলেজের রমরমা হলে কি ভয়ানক পরিণতি হতে পারে তার কিছু নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। রাজ্যে বিএড, ডিএলএড ডিগ্রি ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সম্ভাবনা নেই বর্তমানে, সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে তো হবেই না। বেসরকারি হলে দু’-এক জায়গায় ওই সংশ্লিষ্ট স্কুলের কর্তৃপক্ষ আপনাকে এই ডিগ্রিতে ভর্তি হতে বলবে। এই ডিগ্রিগুলো বেশ কিছু বছর আগেও সরকারি কলেজে করানো হতো। এদিকে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো রমরমিয়ে তৈরি হয়েছে এই বিএড, ডিএলএড ডিগ্রির কলেজ।
শিক্ষায় একদিকে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি সংশয়ের মুখে কারণ রাজ্যের শাসক দল চাকরি বিক্রি করেছে। অন্যদিকে কলেজের অ্যাডমিশনের দুর্নীতির পাশাপাশি এখন কলেজে ভর্তির ফর্ম বেরোয়নি। সবটাই হয়তো পরিকল্পনা যৌবনের, আঠেরোর আওয়াজকে দমিয়ে দিতে। শিক্ষার উপর এই পরিকল্পিত আক্রমণের জেরে যুক্তিবাদী সমাজের থেকে এক আনুগত্যের সমাজ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রের এবং রাজ্যের শাসক দল। বেশ কিছু বছর ধরেই এই আক্রমণের তীব্রতা বেড়েছে, জাতীয় শিক্ষা নীতি থেকে রাজ্যের যে শিক্ষা নীতি দুই মিলেমিশে ছাত্রসমাজের লেখাপড়ার অভিমুখকে পালটানোর চেষ্টা করছে। শিক্ষার উপর এই আক্রমণকে প্রতিহত করার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে রাস্তায় নেমে এই ফর্ম ফিলাপ বন্ধ কেন এই নিয়ে তীব্র আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা। এই সমস্যার জন্য যেমন ১০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর জীবন বিপন্ন, এর পাশাপাশি এদের বাড়ির লোকদেরও অবস্থা ভাল নয়। মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে অর্ধেক কোটি মানুষ, এর থেকে মুক্তি পেতে, শিক্ষা বাঁচাতে রাজ্যের সমস্ত শিক্ষানুরাগী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কি পথ আছে!
College Admission
ভর্তি বন্ধ, কবে যাবো কলেজে

×
Comments :0