Post Editorial

মেরুকরণ সাম্প্রদায়িকতা রুটিরুজির লড়াই

উত্তর সম্পাদকীয়​

রাহুল আমিন গাজী


ইউরোপে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। ইউরোপে বুর্জোয়ারা নেতৃত্ব দিয়ে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিয়ে বিপ্লব সংঘটিত করে সামন্তবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। ফলে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে উপরিকাঠামোতে সামন্তবাদের সহায়ক ধর্ম, দর্শন, রাজনীতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে ধর্মীয় রীতিনীতি ধর্মান্ধতা বর্ণবাদ জাতপাত সহ সঙ্কীর্ণতাকে চূর্ণ করে পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের পথ খুলে দিয়েছিল। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ধর্মকে জনগণের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে ঠেলে দিয়ে যুক্তিবাদ গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে বিকাশের পথে এগিয়েছিল। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। ধর্ম ব্যক্তির, রাষ্ট্র সবার। রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী উন্নয়নে ধর্মের কোনও ভূমিকা থাকবে না। ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাববাদী দর্শনকে পিছনে রেখে বস্তুবাদী দর্শনকে ভিত্তি করে চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলেছিল, আর এটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ভিত্তি।
সংবিধানে কি আছে?
ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ নম্বর ধারায় ধর্মের স্বাধীনতা অনুসারে ভারতের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ অনুশীলন এবং প্রচার করার অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্র অথবা তার অধীনস্ত কোনও সংস্থা এই প্রশ্নের কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতশূন্য মনোভাব অবলম্বন করবে। রাষ্ট্র সব ধর্মের প্রতি সম মনোভাব গ্রহণ করবে, কোনও একটি ধর্মকে পছন্দের ভিত্তিতে তার প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করা যাবে না। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো যাবে না।
আঁতুড় ঘর
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গড়ে ওঠে। বিজেপি একটি সাধারণ বুর্জোয়া দল নয়। বিজেপি হল সর্বাধিক প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও বিভেদপন্থী দল। অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব নিয়ে চলে, সে উগ্র জাতীয়তাবাদী। এই দলের আঁতুড় ঘর হলো আরএসএস। বিজেপি হলো আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা। আরএসএস মূলত ফ্যাসিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। আরএসএস’র স্রষ্টা গোলওয়ালকর লিখেছেন— হিটলারের মতাদর্শ তার প্রেরণা। এই হিটলারই জার্মান জাতির রক্তে কোনও মিশ্রণ চলবে না, এই স্লোগান তুলে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে খুন করেছিল। তিনি হিটলারকে প্রশংসা করতেন ও গান্ধীজীকে ঘৃণা করতেন। তিনি তার- ‘We or our nationhood defined’ বইতে লিখেছিলেন — ‘হিন্দুস্তানে থাকতে হলে বিদেশি জাতিগুলিকে হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে গ্রহণ করতে হবে। হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম করতে হবে। হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতিকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা পোষণ করা যাবে না। হয় তারা এসব করবে নয়তো হিন্দু জাতির পদানত হয়ে থাকবে। এসব না মানলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে থাকবে।’ আরএসএস বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে অস্বীকার করে। এই আরএসএস-ই বিজেপিকে পরিচালনা করে। বিজেপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় সেনাবাহিনী, মিলিটারি, পুলিশ সাধারণ প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিক জীবনের সর্বত্র মূলত মুসলিমকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করে। ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল, এনআরসি আইন, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির গড়ার পরে, মসজিদের তলায় মন্দির খোঁজা শুরু হলো। উত্তেজনা দাঙ্গা সংঘটিত হল। ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ভেবে সুপ্রিম কোর্ট মন্দির খোঁজার যাবতীয় সমীক্ষা বন্ধ করে দিল। জ্বলন্ত আর্থিক সঙ্কট ও সমস্যাকে পিছনে ফেলে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে চায়। গোরু মরলে শকুন খুশি হয় আর বন্যা দুর্ভিক্ষ হলে মজুতদারদের পোয়াবারো। হানাহানি বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে ভোট বাড়ে আসন বাড়ে, নির্বাচনে জেতা সহজ হয়। এসবের মধ্যে দিয়েই শাসকশ্রেণির নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা ও বর্বরতার মুখ সামনে চলে আসে।
নাগপুর থেকে তৃণমূল
৮০-র দশকে সমগ্র দেশ গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে ঘনীভূত ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক-আইএমএফ নির্দেশিত পথে বিশ্বায়নের দুটি বাহু উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের উপর ভর করে রাহুমুক্ত হতে চেয়েছিল। কংগ্রেসের জনবিরোধী অর্থনীতি, স্বৈরতান্ত্রিক কাজকর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসমুখী মনোভাবের কারণে এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কংগ্রেস ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেঙে পড়েছিল। চিরন্তন কমিউনিস্ট বিরোধী আরএসএস নাগপুর থেকে পরিকল্পনা করে কংগ্রেসের ভাঙা ঘরে কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তি মমতা ব্যানার্জিকে প্রজেক্ট করে বামফ্রন্টকে ঠেকাতে মুখোমুখি তৃণমূলকে দাঁড় করিয়ে সাফল্য পেয়েছিল। রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি আরএসএস’র কাছে তুরুপের তাস।
১৯৯৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল সুপ্রিম মমতা ব্যানার্জি বিজেপি’র সঙ্গে জোট করেন এবং পরে রেলমন্ত্রী হন। তৃণমূল কংগ্রেসের গঠনের পর মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন— বিজেপি অচ্ছুৎ নয়, সাম্প্রদায়িক দল নয়, ওরা আমাদের দেখবে, আমরা ওদের দেখব। রতনে রতন চিনেছে। বিজেপি তৃণমূলের সাহায্য নিয়ে বাংলার মাটিতে আরএসএস’র ফ্যাসিবাদী দর্শন এবং বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচারের সুযোগ করে নেয়। তৃণমূলের পাঁকে বিজেপি পদ্মফুল ফুটিয়েছে। তৃণমূলের ব্যবস্থাপনায় বিজেপি’র পোঁতা ঘাস ঝাড়ে পরিণত হয়েছিল। ২০০৩ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে আরএসএস’র ‘কমিউনিস্ট আতঙ্কবাদ’ বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে সঙ্ঘ নেতা মোহন ভাগবত, মদন দাস দেবী, বলবীর পুঞ্জ মমতা ব্যানার্জিকে দেবী দুর্গা প্রশংসায় ভূষিত করেন। মমতা ব্যানার্জি আরএসএস-কে প্রশংসা করে দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করেছিলেন। ২০০২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই রাজ্যের মমতা ব্যানার্জি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন। একইভাবে ২০১১ সালে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আশীর্বাদ ও পরামর্শ ‘প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিন’।
মেরুকরণ থেকে বিভাজন
জ্যোতি বসু বার বার বলতেন তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ, ওরা সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে এ রাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে। এ রাজ্যের মানুষ বিজেপি-কে চিনত না জানতো না। তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি-কে মাটির তলা থেকে তুলে এনে সিপিআই(এম)-কে ধ্বংস করার জন্য স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করে সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতি গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদি কায়দায় প্রশাসন পরিচালনা করে তৃণমূল। তৃণমূল কংগ্রেস হলো গ্রামাঞ্চলে গজিয়ে ওঠা নব্য ধনী ও নিকৃষ্ট সমাজবিরোধীদের আশ্রয়স্থল। মুখরোচক, চটকদারি, মনমোহিনী ও মিথ্যাচার ওদের সম্বল। জন্মলগ্ন থেকে বিজেপি’র হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের যাত্রা শুরু।
রাজ্যে মেরুকরণের প্রাথমিক পর্বে ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। বাঙালির জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা স্বাভাবিক ছন্দে হয় এবং ধর্ম মত নির্বিশেষে সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু রামনবমী হনুমান জয়ন্তীতে খোলা তরোয়াল, কুঠার, ত্রিশূল হাতে নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূলের নেতা নেত্রী জনপ্রতিনিধিরা মাইক বাজিয়ে বাদ্য যন্ত্র সহযোগে রাস্তায় তাণ্ডব করে। দুই দলের মধ্যে চলে নির্বোধ প্রতিযোগিতা। চলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন। বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে চলে সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতায় কে কাকে টেক্কা দিতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কর্মীরা, মাথায় ফেট্টি বেঁধে রে রে করে বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরংবলীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সশস্ত্র মিছিল করে। দলগতভাবে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি’র পাল থেকে সাম্প্রদায়িক বাতাস কেড়ে নেওয়ার জন্য এ সব সংগঠিত করে। সশস্ত্র শোভাযাত্রার পরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা থেকে এক লহমায় সম্প্রীতির ঐতিহ্য কালিমালিক্ত হয়েছে বারবার। 
তৃণমূল সরকারের আমলে কাকিনাড়া থেকে আসানসোল, রানীগঞ্জের শিল্পাঞ্চল, পুরুলিয়া আরশা, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, নোলিয়াখালি, নৈহাটি সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক ঘটনায় দোকান ভাঙচুর, লুটপাট ও জীবনহানি ঘটেছে। বহু মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়, ঘর জ্বলে, চোখের জলে গরিবরা ঘর ছাড়া হয়। হিংসার রাজনৈতিক শিকার হতে হয় শ্রমজীবী মানুষের কাজের জায়গাগুলো। বিভেদ পন্থা, সাম্প্রদায়িকতা উগ্রতার হিংসার ফলে হয় গরিবের সর্বনাশ, প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বার্থান্বেষী মানুষের পৌষ মাস। মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা দূরে ঠেলে রেখে তৃণমূল বিজেপি’র মধ্যে ইফতার পার্টি, ইমাম-পুরোহিত ভাতা, রাম মন্দির ও জগন্নাথের মন্দির গড়া নিয়ে চলে অশুভ প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি ওয়াকফ সংশোধিত আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, শামশেরগঞ্জ ধুলিয়ানা এবং সুতিতে দুঃখজনক সাম্প্রদায়িক ঘটনায় তিনজন মানুষের মৃত্যু হলো। এইসব ঘটনা যারাই করুন না কেন মূলত পক্ষান্তরে বিজেপি আরএসএসের সাম্প্রদায়িক জিগির ও প্রচারকে সাহায্য করে এবং ওয়াকফ আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু এই রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বামপন্থী সহ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন মাথা উঁচু করে বুকে বল ভরসা নিয়ে রাত জেগে রাস্তায় নেমে নিরীহ অসহায় আতঙ্কিত মানুষের নিরাপত্তা দিয়েছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেছে। এটাই বাংলার সম্প্রীতি গৌরবজনক ঐতিহ্যের চেনা মুখ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এই চেনা মুখকে রক্ষা করতে হবে।
মিথ্যাচার বাম নয় রাম
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে মিথ্যা নির্মাণ করে সংবাদপত্র ও স্বার্থান্বেষী মহল হাওয়া তুলে দিল বামপন্থীরা পারবে না, বিজেপি তৃণমূলকে মোকাবিলা করবে। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারকে হটানোর জন্য যারা এই তৃণমূলকে বিকল্প ভেবেছিল তাদেরই একটি বড় অংশ তৃণমূলের জনবিরোধী কাজকর্মে তিক্ত, বিরক্ত ও ক্ষোভ প্রকাশ করে হাত কামড়ে তৃণমূল হটানোর জন্য বিজেপি-কে মদত দিয়েছিল। যারা বিছানায় ছারপোকা মারার জন্য ঘরে আগুন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল, তারাই মূলত তৃণমূলকে হটিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে। গত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে গোদি মিডিয়া এবং আরএসএস, বিজেপি ও আইটি সেল ‘বাম নয় রাম’ প্রচার তুলে ভোট মেরুকরণের রাজনীতিতে তৃণমূল এবং বিজেপি বিপুল সাফল্য পেয়েছে।
যাহা বিজেপি তাহাই তৃণমূল
মানুষের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা কি? তৃণমূলের ছত্রছায়ায় লুম্পেন ও নিকৃষ্ট ধরনের সমাজবিরোধী, একেবারে জলজ্যান্ত স্বৈরাচারী শাসন। এদের প্রকাশ্য ঘোষণা রাজ্যে চাই বিরোধী শূন্য, প্রতিবাদ শূন্য, রানীর রাজত্বে ট্যাঁ-ফো চলবে না। মমতার অনুমতি ছাড়া পাতা নড়বে না, পাখি ডাকবে না। ক্ষমতা স্থায়ী করতে এক হাতে সন্ত্রাস অন্য হাতে জাতপাত ও সাম্প্রদায়িকতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। তৃণমল দল মানে অর্থ স্বার্থ ক্ষমতা। আর ক্ষমতা মানেই গাড়ি-বাড়ি দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্থের পাহাড়। এদের কাছে নীতি নয়, নেতাই আসল। আদর্শের কোনও বালাই নেই। জাত পাত বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা তৃণমূলের স্বভাবজাত। 
অন্যদিকে বিজেপি স্বৈরাচারী, বিভেদ পন্থী ও সাম্প্রদায়িক। নির্বাচনের আগে বা পরে বিরামহীনভাবে তৃণমূল থেকে বিজেপি, বিজেপি থেকে তৃণমূল যাতায়াত হচ্ছে। কে কখন জামা বদলের মতো দলবদল করছে, জানাবোঝাই মুশকিল। আম গাছের বানর যদি জাম গাছে যায়, তবে তা হনুমান হয়ে যায় না। নাগপুরের তৈরি করা রিহার্সাল অনুযায়ী দু’জনের হাতে অভিনয়ের স্ক্রীপ্ট ধরিয়ে দিয়ে যাত্রা মঞ্চে রাম রাবণের নকল যুদ্ধ দেখায়। মানুষ রুদ্ধশ্বাস নাটক দেখে, কে বাঁচে কে মরে ভেবে মানুষ উত্তেজিত হয়। কিন্তু যাত্রা শেষে গ্রিনরুমে রাম রাবণ একই বিড়ির সুখটান মারে। ত্রিপুরাতে বিজেপি এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস, পয়সার এপিঠ ওপিঠ। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এবং লোকসভায় বিল পাশের ক্ষেত্রে তৃণমূলের ভূমিকা বিজেপি’র পক্ষে। সুতরাং তৃণমূল যদি হয় বন্দুকের গুলি, বিজেপি হলো ফাঁসির দড়ি। দুটোর পরিণতি হল মৃত্যু, আপনি কি এর কোনটাই বেছে নেবেন?
এবারে চাই রাম নয় বাম
মূল কথা হলো মানুষের জীবনে সমস্ত সমস্যা পিছনে ঠেলে দেওয়া, মানুষ রাস্তাঘাটে হাটে বাজারে গঞ্জে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিযোগিতার মধ্যে ডুবে থাক এবং বিভাজনের রাজনীতি সামনে চলে আসুক। তাই বিজেপি’র সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেই দিয়েছে বাংলায় ভাত নয় জাতের লড়াই হবে। মমতা, তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে আরএসএস’র যতই বিরক্তি থাকুক না কেন, চির শত্রু কমিউনিস্টদের ধ্বংস করার জন্য তৃণমূলকে অবশ্যই প্রজেক্ট করবে। একদিকে মমতা ব্যানার্জি দীঘাতে সরকারি অর্থে জগন্নাথ মন্দির গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিভাজন এবং ধর্মীয় মেরুকরণ রাজনীতিটাকে সামনে আনতে চাইছেন, অন্যদিকে তিনিই  সিঙ্গুরে শিল্পের জন্য জমি নেওয়ার প্রশ্নে সীতার গণ্ডি কেটে দিয়েছিলেন। ধ্বংসাত্মক আন্দোলন সংঘটিত করে ৯৭ ভাগ হয়ে যাওয়া শিল্পের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছিলেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী গোর্খা, শেরপা, ভুটিয়া, লেপচা, মতুয়া ও নস্যশেখ ইত্যাদি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য মাত্র ৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন, অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদীর তৈরি রাম মন্দিরের বিকল্প হিসাবে দীঘায় বিপুল পরিমাণ জমিতে ২০১ কোটি টাকা সরকারি অর্থে জগন্নাথের মন্দির নির্মাণ ও সেই সঙ্গে দুর্গা পূজা, ক্লাবগুলোকে কয়েক হাজার কোটি টাকা অনুদান দিয়ে বিভাজন ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে সামনে এনে নির্বাচনী সাফল্য চাইছে। 
তাই এ রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ ভাঙা ছাড়া বামপন্থার কাছে কোনও বিকল্প নেই। রাজ্যে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রধান লক্ষ্য হল, এই মেরুকরণ ভেঙে জনগণের দাবি — চড়ামূল্য বৃদ্ধি, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম, ঋণ মকুব, অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান, শ্রমিকের ন্যূনতম ২৬ হাজার টাকা মজুরি, বন্ধ হয়ে যাওয়া রেগার কাজ চালু করা। সেই সঙ্গে আবাসন ও রেশন ব্যবস্থায় সীমাহীন দুর্নীতি ও সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দুর্নীতি বন্ধ করা ইত্যাদি দাবিসমূহ নিয়ে নিবিড় ঘন প্রচার, দেওয়াল লেখা, মাইক প্রচার, পাড়া বৈঠক গঞ্জ, মোড় ও জনবহুল স্থানে পথসভা সংগঠিত করে ‘তৃণমূল হটাও রাজ্য বাঁচাও, বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও’ এই আওয়াজ তুলে ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রচারের তীব্রতা বাড়াতে হবে এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে আন্দোলনে শামিল করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment